পরাশক্তি হিসেবে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নিত্যনতুন অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা অতীতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে ভবিষ্যতেও। এখন মূলত এই প্রতিযোগিতা চলছে পারমাণবিক বোমার অধিকারী দেশগুলোর মধ্যে। পারমাণবিক বোমার মতো মারণাস্ত্রের মালিক হওয়ার পর এখন তাদের প্রতিযোগিতা কত দূরে এবং কত দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে সেই বোমা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে, সেটা নিয়ে।
এই প্রতিযোগিতা থেকে রাশিয়া তৈরি করে ফেলেছে শব্দের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুতগতিতে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এক ক্ষেপণাস্ত্র। সেই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা বহনেও সক্ষম। সম্প্রতি এ ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই। সঙ্গে এটাও বলেছেন, সারা বিশ্ব এখন তাঁদের ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়।
সাধারণত শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতির ক্ষেপণাস্ত্রকে বলা হয় ‘হাইপারসনিক মিসাইল’। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, ভারতও এই প্রযুক্তির পেছনে ছুটছে। কেউ কেউ পরীক্ষাও চালিয়েছে। কিন্তু কেউই পুতিনের মতো প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এই প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কথা বিশ্বকে জানান দেয়নি।
নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা
রাশিয়া তার নতুন এই হাইপারসনিক মিসাইলের নাম দিয়েছে ‘কিনজাল’। শব্দের গতি প্রতি সেকেণ্ডে ৩৩২ মিটার। কিনজালের গতি শব্দের গতির ১০ গুণ হলে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতি সেকেণ্ডে যাবে ৩ হাজার ৩২০ মিটার। তার মানে কিনজাল এক সেকেন্ডে সোয়া তিন কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়া বিশ্বের যেকোনো স্থানে নির্ভুলভাবে পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম বলে দাবি করেন পুতিন। প্রেসিডেন্ট পুতিন পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে যেদিন এই মারণাস্ত্রের কথা বিশ্বকে জানান দেন, সেদিনই এর সক্ষমতা নিয়ে ভিডিও গ্রাফিকস দেখান তিনি। সেই গ্রাফিকসে দেখানো হয়, কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টির মতো আঘাত হানছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া মস্কো থেকে কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে মাত্র সাড়ে ৩৭ মিনিটে তা ফ্লোরিডায় আঘাত হানবে (আকাশপথে মস্কো-ফ্লোরিডা দূরত্ব ৭৪৭২ কিলোমিটার)।
রাশিয়ার অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান সেরগেই সুরোভিকিন বলেন, এই ক্ষেপণাস্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য এটি উৎক্ষেপণ করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
গ্রাফিকসের মাধ্যমে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ফ্লোরিডায় পতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন এই ঘটনাকে মস্কোর দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বলে উল্লেখ করে।
রাশিয় সত্যিই এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সফল হয়েছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস। তাঁর মন্তব্য, রুশ প্রেসিডেন্ট যে প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলছেন, সত্যিকার অর্থে সেটা হাতে পাওয়া এখনো কয়েক বছরের দূরের বিষয়। ম্যাটিস বলেন, ‘আমি মনে করি, রুশ সামরিক সক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর মস্কোর এই ঘোষণা ওয়াশিংটনের নীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।’
গ্রাফিকসে কেন ফ্লোরিডা?
বেশ কয়েক বছর ধরেই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের কথা মনে করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। বলা যায়, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দিয়ে শুরু। সর্বশেষ সিরিয়ায় তো পুরোপুরি মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে ওয়াশিংটন-মস্কো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বকে পুতিন বেশ একটা ধাক্কাই দিয়েছেন। রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটা বলয় প্রকাশ্যই গড়ে তুলেছেন। এর বাইরে বেশ কিছু দেশের অপ্রকাশ্য সমর্থন তো আছেই। তবে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রই যে রাশিয়ার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমান বিশ্বে যাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তাদেরই শক্তিধর হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের তথ্যমতে, বিশ্বে মোট ১৪ হাজার ৯০০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এর সাত হাজারই আছে রাশিয়ার হাতে। রাশিয়ার পরের অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের হাতে রয়েছে ৬ হাজার ৮০০টি। এ ছাড়া ফ্রান্সের কাছে ৩০০, চীনের ২৬০, যুক্তরাজ্যের ২১৫, পাকিস্তানের ১২০, ভারতের ১২০, ইসরায়েলের ৮০ ও উত্তর কোরিয়ার কাছে আছে ১০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
তবে এমন ধারণা প্রচলিত যে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা প্রকাশিত তথ্যের চেয়েও অনেক বেশি। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে নয়টি দেশের হাতে মোট ১৫ হাজার ৩৯৫টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, গ্রাফিকসের মাধ্যমে ফ্লোরিডায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্রবর্ষণ যুদ্ধের কোনো কৌশল বলে মনে হয় না। এটা একটা বার্তা। ভিডিও গ্রাফিকসটিও প্রতীকী। তবে গ্রাফিকসে ফ্লোরিডায় ক্ষেপণাস্ত্রবর্ষণ কথার লড়াইয়ের অংশ।