সাত বছর ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ। গৃহহীন হয়েছে লাখো। দেশের উল্লেখযোগ্য একাংশের বাড়িঘর, অন্যান্য স্থাপনা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যেখানে মানুষকে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে, সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের চোখে-মুখে তার ছাপ নেই। তাঁর পদত্যাগে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপও তাঁকে এতটুকু টলাতে পারেনি। তাঁর এভাবে টিকে থাকার রহস্য কী?
এরই মধ্যে পূর্ব গৌতার বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত দুমা শহরে ৭ এপ্রিল রাসায়নিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলার জন্য প্রেসিডেন্ট বাশার সরকারকে দায়ী করে গত শনিবার সিরিয়ার সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এ হামলা নিজ শাসনে সিরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাশারের কথিত চেষ্টায় এক বড় আঘাত হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ হামলার লক্ষ্য যে প্রেসিডেন্ট বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, সেই ধারণা কমই।
সিরিয়ায় ২০১১ সালে যখন স্বৈরশাসক বাশারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুরু, প্রাথমিক পর্যায়ে তখন মনে করা হচ্ছিল আরব বসন্তের ঢেউয়ে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসকদের তালিকায় তাঁর নামও উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বিদ্রোহীরা এখন পুরোপুরি কোণঠাসা। বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিকেরা প্রেসিডেন্ট বাশার সরকারের বিরোধিতায় সরব। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁদের একজন। এরপরও তাঁরা বলছেন, সিরিয়ার শীর্ষ পদে হয়তো আসাদই থেকে যাবেন। বাশারের টিকে থাকার এ ক্ষমতার পেছনে কারণ খতিয়ে দেখেছে আল-জাজিরা।
বিদেশি সমর্থন
২০১২ সালের গ্রীষ্মকাল। সিরীয় বিদ্রোহীদের তখন অগ্রযাত্রা চলছে। এমনই একদিন মধ্য দামেস্কে ঘটল এক প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণ। তাতে নিহত হন সিরিয়া সরকারের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তাও। তাঁদের অন্যতম প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট বাশারের নিকটাত্মীয় আসিফ শওকত। এতে বিদ্রোহীরা ভেবেছিল, তাদের জয় কাছাকাছি। বাশার বাহিনীর এমনই এক দুঃসময়ে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ জোরদার করে মিত্র ইরান। ইরানের সহায়তা অনেকটা স্থলসেনা পাঠানোর মধ্যে সীমিত থাকলেও বাশারের জন্য তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া এগিয়ে আসে আরও এক হাত।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর। রাশিয়া সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর সরাসরি বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে। তখন থেকে বিদ্রোহীদের ওপর আজও চলছে রুশ বাহিনীর বিমান হামলা। রুশদের সহায়তায় একে একে দামেস্কের বড় অংশ ও আলেপ্পো শহরে নিজেদের হারানো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় বাশার সেনারা।
বিদ্রোহীদের বিভক্তি
বিদ্রোহীরা প্রাথমিকভাবে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা দ্রুতই দেখতে পেল, আসাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রচারণা থেকে এ জঙ্গিগোষ্ঠী অনেকটাই দূরে সরছে। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় রাকার মতো প্রধান প্রধান শহর থেকে বিদ্রোহীদের হটিয়ে দেয় আইএস।
একদিকে ইরান ও রুশ বাহিনী এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট সরকারি বাহিনী, অন্যদিকে আইএস-চতুর্মুখী আক্রমণ মোকাবিলায় সিরিয়ায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে বিদ্রোহীরা। এরই মধ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আইএসের কাছ থেকে কিছু এলাকা পুনর্দখলে নিতে পারলেও কুর্দি বাহিনী ও সরকারি বাহিনী হামলা চালিয়ে সেসব ছিনিয়ে নিয়েছে। শুধু আইএস যে বিদ্রোহীদের থেকে দূরে সরে গেছে তা-ই নয়, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন বারো রকমের বিভক্তি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান
পশ্চিমা দেশ ও আঞ্চলিক কিছু শক্তি যেমন তুরস্ক ও সৌদি আরব আসাদবিরোধীদের পক্ষে সোচ্চার। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাশারকে হটাতে কার্যকর পদক্ষেপ তাদের পক্ষ থেকে এখনো দৃশ্যমান নয়।
অভ্যন্তরীণ সমর্থন
দেশবাসীর ব্যাপক ক্ষোভ সত্ত্বেও নিজের সম্প্রদায় ও সুন্নিদের বড় অংশের সমর্থন এখনো পাচ্ছেন বাশার। কারণ, তাঁর কাছ থেকে বিভিন্নভাবে লাভবান হয়েছে এরা। এ জন্য পরিস্থিতির পরিবর্তন তারা চায় না।