দেখতে দুধের মতো হলেও দুধ না। দুধের সঙ্গে কাপড় কাচা ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, সয়াবিন তেল, লবণ, চিনি, স্যালাইন, নিম্ন মানের গুঁড়া দুধ, মারাত্মক সব রাসায়নিক (কেমিক্যাল) আর পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় সাদা পদার্থ। পরে তা বাজারে বেচা হয় দুধ নামে। এ থেকে তৈরি করা হয় ঘি, ছানা, দই, মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন খাবার। দেশের স্বনামধন্য সরকারি-বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোও এই পদার্থ বা ভেজাল দুধ কিনে ব্যবহার করে; বাজারজাত করে সারা দেশে। ভয়ংকর এই কর্মকাণ্ড হচ্ছে দেশের দুগ্ধভাণ্ডারখ্যাত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সাঁথিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায়।
উল্লাপাড়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কালিয়াকৈড়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পশুপালন এবং তা থেকে দুগ্ধ উত্পাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই খামারিদের কাছ থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করে ১৫-১৬ জন ফড়িয়া ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভেজাল দুধ তৈরির অভিযোগ পাওয়া যায়। সেই তথ্যের সূত্রে গত বুধবার সকালে কালিয়াকৈড়ে এক ফড়িয়ার বাড়িতে যাই। তিনি ভয়ে জড়সড়। অনেক বুঝিয়ে তাঁর ভেজাল দুধ তৈরির প্রক্রিয়া জানা গেল। তিনি প্রথমে একটি ব্লেন্ডার মেশিনে আধাকেজি দুধ নিলেন। এর সঙ্গে পরিমাণমতো ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, আধাকেজি সয়াবিন তেল, চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়া দুধসহ বিভিন্ন মাত্রায় কেমিক্যাল মিশিয়ে ১৫ মিনিট ব্লেন্ডার করলেন। আরো তিন দফায় দুধের সঙ্গে এসব পদার্থ ভালোভাবে মেশালেন বা ব্লেন্ডার করলেন। এরপর এসব একটি পাতিলে ঢেলে তাতে এক মণ পানি মেশালেন। তৈরি হয়ে গেল এক মণের বেশি দুধ! এভাবে এক মণ ‘দুধ’ তৈরিতে খরচ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর তা বিক্রি করা হয় এক হাজার ৬০০ টাকা। তিন মণ দুধের সঙ্গে এক মণ ভেজাল দুধ মিশিয়েও ভালো দুধ বলে তিনি সরবরাহ করেন নামি বিভিন্ন দুধ ক্রয়কারী কম্পানি এবং ঘি, ক্রিম, ছানা তৈরির কারখানায়। এভাবে তিনি প্রতিদিন প্রায় দুই মণ ভেজাল দুধ তৈরি করে ছয় মণ খাঁটি দুধের সঙ্গে বেচেন।
এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী আরেকজন ফড়িয়ার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেই বাড়িতে যেতেই বাইরে থেকে ব্লেন্ডার মেশিনের শব্দ পাওয়া গেল। অপরিচিত লোক দেখে তিনি ভয়ে ভড়কে গেলেন। সঙ্গে থাকা ফড়িয়ার কথায় আশ্বস্ত হলেন। তাঁর ঘরে দেখা গেল, তিনিও দুটি ব্লেন্ডার মেশিনের মাধ্যমে একই প্রক্রিয়ায় ‘দুধ’ তৈরি করছেন। তাঁরা জানান, তাঁদের ও পাশের সুজা, চাচকিয়াসহ সব গ্রামের সব ফড়িয়া ব্যবসায়ীই একই অপকর্ম করে। তারা গবাদি পশু পালকদের থেকে প্রতি লিটার দুধ ৪০ টাকায় কিনে কারখানায় একই দামে বেচে ভেজাল মিশিয়ে। দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ভেজাল দুধের লাভের একটা অংশ হাতে ধরিয়ে দিলেই তাঁরা অন্য খামারিদের ভালো দুধের সঙ্গে এই দুধ মিশিয়ে দেন। দুধের ঘনত্ব (ননির ফ্যাট) মেপে টাকা দেওয়ায় অন্য খামারি ও ব্যবসায়ীরা এই ভেজাল দুধের কারণে দুধের দাম কম পায়। কিন্তু ভেজালকারী ও ক্রয়কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিরা এই ভেজাল দুধ ভালো দুধে মিশিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর উচ্চমূল্যে গোখাদ্য কিনে গবাদি পশুকে খাইয়ে দুধ উত্পান করে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সৎ খামারি ও ব্যবসায়ীরা।
গত বুধবার উল্লাপাড়ার লাহিড়ীমোহনপুর বাজারে বেলকুচির ইসমাইল হোসেনের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভেজাল দুধ কিনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছানা ও ঘি তৈরি করা হচ্ছে। শ্রমিকরা বিড়ি টানছে আর কাজ করছে। দুধের ড্রাম ও ক্যানের ওপর মশা-মাছি ভন ভন করছে। একাধিক ড্রামে নোংরা প্লাস্টিকের বোতলে ঠাণ্ডা পানি ভরে দুধ ঠাণ্ডা রাখা হয়েছে। দুধের সঙ্গে চিনি, গুঁড়া দুধ মিশিয়ে ছানা ও ঘি তৈরি করা হচ্ছে। কারখানা ঘেঁষে রয়েছে টয়লেট। ইসমাইল বলেন, প্রতিদিন তিনি ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৪০-৪৫ মণ দুধ কিনে ছানা, ঘি উত্পাদন করে ঢাকায় সরবরাহ করেন। তিনি তাঁর কারখানা নিয়ে প্রতিবেদন না করতে এ প্রতিবেদককে ম্যানেজের চেষ্টা করেন এবং কয়েকজন প্রভাবশালীকে দিয়ে ফোনে চাপ দেন। জানা যায়, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুরের পোরজোনা, কায়েকপুর, বাঘাবাড়ী, চরা চিথুলিয়া, বেড়ার আমাইকোলা, সাঁথিয়ার সেলন্দা, ফরিদপুরের ডেমরা, পার গোপালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য কারখানায় ভেজাল দুধে ঘি, ছানা তৈরি করা হচ্ছে।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, ভেজাল দুধ ও এর তৈরি খাবারে ডায়রিয়া, আমাশয় ও জন্ডিস হতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা এতে আক্রান্ত হতে পারে। এসব খাদ্যে বিষক্রিয়াও হতে পারে।
মিল্ক ভিটার লাহিড়ীমোহনপুর কেন্দ্রের ম্যানেজার মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, মিল্ক ভিটায় কোনো ভেজাল ও নিম্ন মানের দুধ নেওয়া হয় না। এখানে সিন্ডিকেট করে নিম্ন মানের দুধ দেওয়ারও সুযোগ নেই। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এখানে দুধ নেওয়া হয়।
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ভেজাল দুধ চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আর এই কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ