আমরা অত্যাচারিতের পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়াই অত্যাচারীর পাশে। সামাজিকভাবে এটা আমাদের পুরনো অভ্যাস। অভ্যাসটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর কারণও রয়েছে। সেটির নাম ক্ষমতা। আমরা ক্ষমতাকে তোষণ করতে ভালোবাসি। যিনি বা যারা অত্যাচার করেন, আমরা ধরেই নিই, তিনি বা তারা ক্ষমতাবান।
ফলে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবানদের আমরা অকণ্ঠ সমর্থন দিতে গিয়ে, সমর্থন দেই অত্যাচার ও অত্যাচারীকে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যৌন হয়রানির ঘটনা মোটেও দুর্ঘটনা বলতে আমি রাজি নই। এসব কোনো দুর্ঘটনা নয়। এখানে মেয়েদের যখন-তখন, যত্রতত্র অফিসের বস’রা অশ্লীল ইঙ্গিত, যৌন প্রস্তাব, যৌন হয়রানি করেই থাকে। এসব খুব গা-সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। মেয়েদের বেলায় এমন প্রস্তাব আসবেই, এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিই আমরা। কোনো কোনো মেয়ে আবার এসব প্রস্তাবের সুযোগও নিয়ে থাকে। লাভে ও লোভে, তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আশায়।
কেউ কেউ নীরবে সহ্য করে, সাহায্য করে অন্যায়কে। আর খুব কম মেয়ে আছে যারা সাহসী, প্রতিবাদী, রুখে দাঁড়ায় এসব ঘটনায়। সে ঘটনাটি প্রকাশ পায়, কেবল সেটি-ই জানি আমরা। আর জানি না, খবরে আসে না, এমন শত শত ঘটনা আছে। জানি না, তার বড় একটি কারণ মেয়েরা জানাতে চায় না। আমরা পুরুষরা যৌন হয়রানি করবার জন্য একটি শিক্ষা মেয়েদের মাঝে খুব সন্তর্পনে ঢুকিয়ে দিয়েছি। বলেছি, শিখিয়েছি, ভালো মেয়েরা অযাচিত চাপ খেলে, কামড় খেলে, দলাই-মলাই হলেও বলে না, বলবে না, বলতে বারণ। আর মেয়েরাও পুরুষদের কাছে, পুরুষদের শেখানো ফর্মুলায় ‘ভালো মেয়ে’ হতে গিয়ে যত যাই হোক, যত যৌন হেনস্তার ঘটনাই ঘটুক তা লুকিয়ে রাখে, প্রকাশ করে না। এই লুকিয়ে রাখতে পারা, না বলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাটাই পুরুষদের কাছে চূড়ান্ত ‘ভালো মেয়ের সংজ্ঞা’।
বিমানের উপ-ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) নূরুজ্জামান রঞ্জুর যৌন হয়রানি আমাকে বিস্মিত করেনি মোটেও। এমন তো অহরহ ঘটছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাত্রীকে, ব্যাংক কর্মকর্তা জুনিয়র কর্মীকে, সচিব স্টেনোকে, সম্পাদক নারী প্রতিবেদককে, প্রযোজক উঠতি নায়িকাকে, প্রকাশক নতুন লেখিকাকে, সিনিয়র চিকিৎসক ইন্টার্নকে যৌন হয়রানি করছে, কুপ্রস্তাব দিচ্ছে ছোঁয়ার জন্য, শোয়ার জন্য।
ঢাকা টু লন্ডন। সেখানে যাত্রাবিরতির স্থান হোটেল সেইন্ট গিলসে ঘটনাটি ঘটে। বলা হয় ডিনারের দাওয়াত। আসলে ডিনার উপলক্ষ, যৌন হয়রানিই মূল লক্ষ্য ছিল নূরুজ্জামান রঞ্জুর। অবশেষে যা হবার হলো। প্রথমে প্রস্তাব, পরে জোরাজুরি, জবরদস্তি। তরুণীর অসম্মতি। ঢাকায় ফিরে লিখিত অভিযোগ। সাত মাসের দীর্ঘ সময় নিয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রমাণ। নূরুজ্জামান রঞ্জু একজন লম্পট হিসেবে প্রমাণিত হয়ে শাস্তিস্বরূপ ‘চিফ পার্সার’ থেকে ‘ফ্লাইট পার্সার’পদাবনতির নির্দেশ।
কিন্তু সব শেষে ফল হলো উল্টো। যে মেয়েটি ভিকটিম, অত্যাচারিত, যৌন নিপীড়িত, অভিযোগকারী তারই চাকরি নেই। আর বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের প্রশাসন পরিদফতর ও তদন্ত শাখার প্রতিবেদন উপেক্ষা করে নূরুজ্জামান রঞ্জুর ম্যানেজার পদে পদোন্নতি। কেবিন ক্রু মেয়েটি নির্যাতিতও হলো, চাকরিও হারালোÑ আসলে বাস্তবতা এটাই।
আমাদের মুখে এক, অন্তরে আরেক, কাজে অন্য। তা না হলে নূরুজ্জামান রঞ্জুরা কী করে অভিযোগ প্রমাণিত হবার পরও চাকরিতে থাকেন, পদোন্নতি পান। সব সময়ই দেখি যৌন নির্যাতক, নিপীড়ক কোনো দলের সমর্থক হলে, সে দলের লোকজন কী করে তার যৌন হয়রানি বা ধর্ষণকে ‘লজিক্যাল অ্যান্ড লিগালাইজ’ করা যায়, তাতে রীতিমত উঠেপড়ে লাগেন। আসলে আমরা ভাবি যে করেই হোক, ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানকে টিকিয়ে রাখতে হবে, নিজেদের স্বার্থে। এটি বড় ভুল, বড় অন্যায়। অন্যায়কে সমর্থন দিলে বরং ক্ষমতারই ক্ষতি। নয়তো ক্ষমতার প্রতি, ক্ষমতাবান, প্রভাবশালীদের প্রতি লোকের নেতিবাচক মনোভঙ্গির যে পাহাড় তা শেষাবধি গুঁড়িয়ে দেবে ক্ষমতাকেই। কেন না, মানুষের ক্ষোভ, যে কোনো দৃশ্যমান ক্ষমতার চাইতেও ক্ষমতাবান।
শুধু রঞ্জু কেন, আরও যত লম্পট আছে, যৌন নিপীড়ক আছে, শিশু উৎপীড়ক আছে, যৌন হেনস্তাকারী আছে, ধর্ষক আছেÑ লাথি দিয়ে সরান সবগুলোকে, আইনের আওতায় আনুন। বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করুন। নয়তো ফুসে উঠবে একদিন সাধারণ মানুষই, সেদিন বেশি দূরে নয়।
লেখক: জব্বার হোসেন, সাংবাদিক, কলামিস্ট
সৌজন্যে: জাগো নিউজ