কোরীয় উপদ্বীপ ভাগ হয়েছে আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালে। ভাগের পিছনে কাজ করেছে দুই সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকার আশির্বাদে জন্ম নিল পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের আশির্বাদে সমাজতন্ত্রী উত্তর কোরিয়া। বিভক্তির দুই বছর পেরোতেই ১৯৫০-১৯৫৩ তিন বছরের রক্তক্ষয়ী কোরীয় যুদ্ধের ফলে উপদ্বীপটির পূণরায় একত্র হওয়া পুরোপুরি ভেস্তে যায়। কিন্তু দুই কোরিয়া নিয়ে কিছুদিন যাবত নতুন একটি সমীকরণ দৃশ্যমান হচ্ছে।
গত দুই মাসে কয়েকটি ঘটনাকে সামনে রাখলে মনে হবে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৩তম শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বোন কিম ইয়ো জং। শীতকালীন অলিম্পিকে দুই দেশের খেলোয়াররা এক পাতাকাতলে আসে। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বৈঠক করে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দল। কিম ইয়ো জং তার ভাই কিম জং উনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে পিয়ং ইয়ং সফরের আমন্ত্রণ পত্র দেন। কোরিয়া বিভক্তির পর এই প্রথম কিম পরিবারের কেউ দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছে। কিম ইয়ো জংয়ের সিউলে আসার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি শুধু কিম জং উনের ছোট বোনই নন, ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স জৈষ্ঠ কর্মকর্তা। কিম ইয়ো জং কে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন।
ফ্রেব্রুয়ারীর চতুর্থ সপ্তাহে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল দক্ষিণ কোরিয়ায় যায়। ক্ষমতাসীন ওয়ার্কাস পার্টি অব কোরিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী জেনারেল কিম ইয়োং চোল প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দলটি তিন দিনের সফর সম্পন্ন করে।
গত ৫ মার্চ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমনের বিষয়ে আলোচনার জন্য তার গোয়েন্দা প্রধানসহ বিশেষ দূতদের উত্তর কোরিয়া পাঠান। দুই দিনের এই সফরে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়। মুনের প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নেতৃত্বে ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের প্রধান হুনসহ ১০ সদস্যের বিশেষ প্রতিনিধি দলটি পিয়ং ইয়ং যায়। কোরিয়ার দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। সিউলের প্রতিনিধিদের জন্য নৈশভোজেরও আয়োজন করেছেন তিনি। ২০১১ সালে ক্ষমতায় বসার পর এই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে কোনো বৈঠকে মিলিত হলেন কিম। বৈঠকটি চার ঘন্টাব্যাপী হয়েছিল।
সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে গত এক দশক পর এপ্রিলের ১ ও ৩ তারিখ দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীরা উত্তর কোরিয়ার দুটি কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছে।
ইতোমধ্যে দুই কোরিয়ার নেতা ও প্রেসিডেন্ট আগামী ২৭ এপ্রিল অসামরীকিকরণ জোন পানমুনজমে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছেন। বৈঠকের পর উত্তর কোরিয়া কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণুমুক্ত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পিয়ং ইয়ং বলেছে, “তাদের সরকারের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়া হলে এবং তাদের দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হুমকি প্রত্যাহার করা হলে পরমাণু অস্ত্র রাখার কোনো দরকার হবে না।” দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিদলটি দেশটির প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন -এর একটি ব্যক্তিগত চিঠি কিমের কাছে হস্তান্তর করে।সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের বরফ আসলেই গলতে শুরু করেছে। যদিও আমেরিকা আলোচনা চায়, কিন্তু দুই কোরিয়ারই কোরিয়া পুনরেকত্রীকরণ বিষয়ক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ আমেরিকার মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন, জাতীয় পূণর্গঠনে ইতিহাস রচনার কথা বলেছেন।
আপাত দৃষ্টিতে এই আলোচনার পিছনে আমেরিকার প্রবল ইচ্ছা আছে বলে মনে হলেও আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত। তাদের প্রভাব অব্যাহত রাখতে কিমের বোন আসার সাথে সাথে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও দক্ষিণ কোরিয়া সফরে এসেছে। পরে অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের বিশেষ দূত তার মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্পও উপস্থিত থাকে। অন্যদিকে গত একমাসে আমেরিকা উত্তর কোরিয়াকে উদ্দেশ্য করে অনেক অপ্রীতিকর ও উস্কানিমূলক কথা বলেছে। আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তর কোরিয়াকে উস্কে দিয়ে আলোচনার পথ রুদ্ধ করা। কিন্তু অন্যবারের মত জবাব না দিয়ে উত্তর কোরিয়া চুপ থেকেছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে গোলকধাঁধায় রেখে গত মার্চের শেষ সপ্তাহে চীনে ৪ দিনের গোপন সফর শেষ করেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। সফর শেষ হবার পর দুই দেশ সফরের কথা স্বীকার করে। এই সফরের মাধ্যমে বেশ কিছু দিন যাবত চলা চীন ও উত্তর কোরিয়ার মনোমালিন্য কমিয়ে আনা হয়েছে। মূলতঃ উত্তর কোরিয়ার বড় ভাই এর ভূমিকা নিয়ে এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়া ও মে মাসে আমেরিকার সাথে শীর্ষ বৈঠকের কূটনৈতিক চালই বাতলে দিয়েছে চীন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন চীনের প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, “শর্ত সাপেক্ষে উত্তর কোরিয়া পারমানবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে রাজি আছে।” আসলে এই কথাটাই চীনের শিখিয়ে দেয়া উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক চালের প্রথম ধাপ।
আমেরিকার সাথে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের পর বুঝা যাবে উত্তর কোরিয়ায় কার কূটনীতি সফল হয়, আমেরিকা নাকি চীনের। এদিকে মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিমের বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ, রাশিয়া, চীন ও সিআইএ।
এখন কথা হচ্ছে দুই কোরিয়া কি আসলেই পুনরায় একত্র হতে পারবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে প্রায় ৪৫ বছর বিভক্তি পর ১৯৯০ সালের ১৩ অক্টোবর বার্লিন প্রাচীরের পতনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম জার্মান ও পূর্ব জার্মান পুনঃএকত্রিকরণ সম্পন্ন হয়। পশ্চিম জার্মান ছিল পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ। পূর্ব জার্মান ছিল সমাজতন্ত্রী অর্থনীতির দেশ।
১৯৫৪-১৯৭৬ সাল প্রায় ২২ বছর পর উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুনরায় একত্রীত হয়ে একক ভিয়েতনাম গঠিত হয়। পূর্বে উত্তর ভিয়েতনাম ছিল সমাজতন্ত্রী দেশ ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছিল সমাজতন্ত্রবিরোধী দেশ। আমেরিকা পুনঃএকত্রীকরণ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেও ব্যর্থ হয়।
দুই কোরিয়ার জাতিগতভাবে এক জাতি। দুই কোরিয়ার ভাষা এক। অন্য জাতি বা অন্য ভাষার লোকজন খুবই কম। দুই দেশের মুদ্রার নামই ওন। দুটি দেশ এক হওয়ার জন্য এসব বড় নিয়ামকের ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্মগত দিক দিয়ে দুই কোরিয়ার একত্রে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ ভাগ লোক কোন ধর্ম পালন করেনা, ৪৫ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ২০ ভাগ খিস্টান ধর্মাবলম্বী। ৬০ হাজারের মত স্থানীয় কোরীয় মুসলিমও সেখানে বাস করে। দুটি দেশের জনগণের মনে এক হওয়ার ইচ্ছা সবসময়ই কম বেশি ছিল। যে কারণে দুটি দেশই পনঃরেকত্রীকরণ মন্ত্রনালয় রেখেছে। তবে একত্রীকরণে যেসব বাধা সামনে আসবে সেগুলো অতিক্রম করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
প্রথমতঃ দুই দেশই যদি আদর্শিক জায়গায় ছাড় না দেয়; বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের খিচুড়িতত্ব শাসন চলছে। আদর্শিক ছাড় দিলেও ক্ষমতার স্বাদ থেকে কিম পরিবার বিরত হওয়াটা কঠিন হবে। ছাড় না দিয়েও উপায় নেই উত্তর কোরিয়ার। ২০০৬ সাল থেকে চলা দশকব্যাপী অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বার্ষিক চাঁদা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে দেশটি। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি দেশের অর্থনৈতিক অবরোধে উত্তর কোরিয়ার তেল আমদানি ৯০ ভাগ কমে গেছে। বুঝাই যাচ্ছে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খু্ব নাজুক।
দ্বিতীয়তঃ দুই দেশ এক হলে উত্তর কোরিয়ার নাজুক অর্থনীতি ও জনগণের জীবনমান উন্নত করণে দক্ষিণ কোরিয়াকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়াকে টাইগার অর্থনীতির দেশ বলা হয়। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া ১১তম। তারপরও সামগ্রিকভাবে পুরো অর্থনীতিতে একটা ধাক্কা লাগতে পারে। এক্ষেত্রে জনগণ ও সরকার কতটুকু উদার হতে পারবে সেটা ভাবার বিষয়। পশ্চিম জার্মানের সাথে পূর্ব জার্মানের অর্থনৈতিক ব্যবধান এতো বেশি ছিল যে, এখন পর্যন্ত জার্মানি প্রতিবছর পূর্ব জার্মানির প্রদেশগুলোর উন্নয়নের জন্য বাৎসরিক ১০ বিলিয়ন ইউরো খরচ করছে ।
তৃতীয়ত ও প্রধানতঃ দুই দেশ এক হলে দেশটির আয়তন, অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও সামরিক শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে। সামরিক শক্তিতে দেশটি অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে। কেননা দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে প্রচুর অর্থ ও উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক প্রযুক্তি। যা অনেকের জন্য মাথাব্যাথার কারণ। মোড়ল দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের ও প্রতিবেশী জাপানের জন্য এটা মেনে নেয়া অসম্ভব প্রায়। আমেরিকা ও রাশিয়া কেউ চাইবেনা তাদের কর্তৃত্ব থেকে দেশ দুটি হাতছাড়া হয়ে যাক। কেউ চাইবেনা নতুন আরেকটি প্রতিযোগী ও পরাশক্তির উদ্ভব হোক। তাই একত্রীকরণ প্রতিরোধে সম্ভাব্য সবধরণের প্রচেষ্টাই মোড়ল দেশ দুটি করবে। দুই দেশ এক হলে দূরের দেশ আমেরিকার প্রভাব অনেকাংশে শেষ হয়ে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তাদের সবগুলো সামরিক ঘাটি সরাতে বাধ্য হবে। তখন উত্তর ও পূর্ব এশিয়ায় শুধুমাত্র জাপানেই আমেরিকার সামরিক ঘাটি অবশিষ্ট থাকবে। বলাবাহুল্য কোরিয়ার সাথে স্থল সীমান্তে শুধুমাত্র দুটি দেশ সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ও চীনের সংযোগ রয়েছে। তাই কোরীয় উপদ্বীপে সমাজতন্ত্রের প্রভাব থাকবেই। কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার বহুল পরিচিত ‘ডমিনো তত্ত্ব’ কোন কাজে আসবেনা।
সবমিলিয়ে বলা যায় দুই কোরিয়ার সম্পর্ক উন্নয়ন বা এক হওয়া অনেক কঠিন ও দীর্ঘসূত্রীতায় গাথা রয়েছে। একটু অসতর্কতায় পরাশক্তি দেশগুলোর ফাঁদে পা দিলে দুই দেশের পুনরেকত্রীকরণ আরও কয়েক দশক পিছিয়ে যেতে পারে।
লিখেছেনঃ আজিজুল ইসলাম সজীব