কিশোর ছেলের লাশ ঈদগাহ ময়দানে রাখা হয়েছে জানাজার জন্য। ইমামতি করবেন বাবা মাওলানা ইমদাদুল রাশিদি। জানাজায় অংশ নিতে ঢল নেমেছে মুসল্লিদের। সাধারণ কোনো জানাজায় এত মুসল্লি আসেন না। কিন্তু আজ এসেছেন। সবাই ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। সবার চোখে প্রতিশোধের আগুন। এমন একটি নিরীহ ছেলেকে কুপিয়ে টুকরা টুকরা করা হয়েছে। এর জবাব দিতেই হবে। নতুবা উগ্রপন্থিদের বাড়াবাড়ির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
আগের দিন থেকে চলা এলাকার থমথমে পরিস্থিতি ঈদগাহে জমায়েতের পর যেন চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা। আগে জানাজা শেষ করতে চান তারা।
ইমাম সাহেব আঁচ করতে পারছিলেন মুসল্লিদের মনের অবস্থা। যে কোনো সময় পাল্টা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে ক্ষুব্ধ যুবকেরা। কিন্তু তিনি এমনটি হতে দিতে চাননা। সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে এই ক্ষোভের আগুন নিভাতেই হবে। জানাজা পড়ানোর আগ মুহূর্তে দাঁড়ালেন মুসল্লিদের উদ্দেশে। ঠাণ্ডা ও দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন-
“গত ৩০ বছর ধরে আমি আপনাদের ইমামের দায়িত্ব পালন করছি। আমার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছাবো, শান্তির বার্তা পৌঁছাবো। আমি যা হারিয়েছি তার কষ্ট থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি শান্তি চাই। আমার ছেলে চলে গেছে। আমি চাই না আর কোনো পরিবার তাদের সন্তানকে হারাক। আমি চাই না আর কোনো ঘরে আগুন জ্বলুক। আমি চাই না আর কারো কোনো ক্ষতি হোক। আল্লাহ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে, কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন। কিন্তু আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আপনাদের কারও নেই।
যদি আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, তাহলে কারো প্রতি আঙ্গুল তুলবেন না। যা ঘটে গেছে তা ষড়যন্ত্র ছিলো। আসানসোলের সব মানুষ আসলে এমন নয়। ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনও মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। ইসলাম শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাস করতে শেখায়। আসানসোলে আজ শান্তিশৃঙ্খলার প্রয়োজন। আপনারা যদি আমাকে আপন মনে করেন, তাহলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের। আর যদি আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে ভাবব, আমি আপনাদের আপন নই। আমি আর এই মসজিদে থাকবো না।চিরতরে আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।” (সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য সিটিজেন)।
খুন হওয়া কিশোরের বাবা তার কষ্ট বুকচাপা দিয়ে উপস্থিত জনতার কাছে এভাবে আকুতি জানাচ্ছেন। কান্নার রোল ওঠে ঈদগাহ ময়দানে। ভারতীয় পত্রিকা দ্য সিটিজেন কথা বলেছে সেখানে উপস্থিত স্থানীয় কাউন্সিলর নাসিম আনসারির সাথে। তিনি বলেন, ‘অন্য সবার মতো আমিও জানাজায় গিয়েছিলাম। ইমাম সাহেব ৭ থেকে ৮ মিনিট কথা বললেন। তখন কাঁদছিলো না এমন একটি লোকও সেখানে ছিলো না। আমরা দেখলাম জনতার চোখেমুখে থাকা ক্ষোভ অল্পক্ষণের মধ্যেই গভীর কষ্টের রূপান্তরিত হলো। এবং জানাজা শেষে সবাই নীরবে যার যার বাড়ি চলে গেল।’
আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারিসহ স্থানীয় প্রশাসন কৃতজ্ঞ ইমাম ইমদাদুল রাশিদির কাছে। জিতেন্দ্র বলেন, ‘ইমাম সাহেবের বক্তব্যই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা রেখেছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। নিজের সন্তানে এভাবে হারিয়েও তিনি শান্তি বজায় রাখতে মানুষের কাছে অনুরোধ করেছেন।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে কাউন্সিলর নাসিম আনসারি বলেন, ‘সন্তানহারা এক বাবার কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এমনটি আমরা আশাই করিনি। এটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য নয়, পুরো ভারতের জন্যই একটা দৃষ্টান্ত। আমি জানাজায় ছিলাম। নিহতের লাশ পাওয়ার পর যুবকরা ক্ষুব্ধ ছিলো। তার বক্তব্যের সময় লোকজন কাঁদতে থাকে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। তিনি যদি শান্তির জন্য অনুরোধ না করতেন তাহলে আসানসোলে আগুন জ্বলতো। আর তা যে ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়তো না আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’
ভারতের সংবাদমাধ্যমের প্রশংসায় ভাসছেন ইমদাদুল রাশিদি। সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি এখনও স্থানীয়দেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সৌহার্দ্য বজায় রেখে চলতে।
পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে গত রোববার রামনবমীর শোভাযাত্রার সময় ইমদাদুলের কিশোর ছেলে সিবতুল্লাহ রাশিদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা। হত্যার সময় ১৬ বছরের কিশোরের বুক চিরে কলজে বের করে টুকরো টুকরো করে কাটে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দাঙ্গাবাজরা। সিবতুল্লাহ মাত্র কিছুদিন হলো এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তার বাবা মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম। লাশের ময়নাতদন্তের পর বৃহস্পতিবার আসর নামাজের আগে সিবতুল্লাহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সিবতুল্লাহর বুক চিরে কলজে বের করার মতো নৃশংসতার কারণে মুসল্লিরা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। কিন্তু বাবার শক্ত অবস্থানে এলাকার পরিবেশ এখন বেশ শান্ত বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘটনা তদন্তে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রশাসনকে।