বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চারটি বিমানবন্দরে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বিমান ওঠানামা করছে। এরমধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দরে আইএলএস (ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম) নেই। একই সঙ্গে ফ্লাইট ওঠানামার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্ট ডপলার ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি অমনি রেঞ্জ (ডিভিওআর) সিস্টেম নেই।
রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দরে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী রানওয়ে নেই। দুর্ঘটনা মোকাবেলায় রেসকিউ অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং (আরএফএফ) যান দুটি থাকার কথা থাকলেও আছে একটি। এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এ তিনটি বিমানবন্দরে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল বলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন বেশি দিন হয়নি। হাতে সময়ও কম। তারপরও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আপস করবেন না। তার মতে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় নিরাপত্তার সব দিক খেয়াল রেখেই এয়ারলাইন্সগুলোকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। তারপরও প্রয়োজন হলে ক্রমান্বয়ে বিমানবন্দরগুলোর রানওয়ের পরিসর বাড়ানো হবে।
জানা গেছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এখানে আইএলএস (ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম) নেই। একই সঙ্গে ফ্লাইট ওঠানামার জন্য সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্ট ডপলার ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি অমনি রেঞ্জ (ডিভিওআর) সিস্টেম নেই। এটি একটি গ্রাউন্ড বেইজড রেডিও নেভিগেশন সিস্টেম। এ পদ্ধতির মাধ্যমে এয়ারক্রাফট থেকে পাইলটরা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। একমাত্র ডিএমই (ডিস্টেন্স মেজারিং ইকুইপমেন্ট (Distance Measuring Equipment (DME) যন্ত্রটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
ডিএমই হল ট্রান্সপোর্ট বেইজড রেডিও নেভিগেশন টেকনোলজি)। এক বছর ধরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নাইট ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটিজ সিস্টেম চালু করা যাচ্ছে না। এ কারণে বেলা ২টার পর থেকে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট কক্সবাজার বিমানবন্দরে ওঠানামা করতে হয়। কারণ ২টার পর থেকে এখানে টাওয়ারের সংকেত পাওয়া যায় না।
অভিযোগ উঠেছে, বরিশাল, রাজশাহী ও সৈয়দপুর- এ তিন বিমানবন্দরে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী রানওয়ে নেই। প্রতিদিন এ তিন এয়ারপোর্টে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা, রিজেন্ট, নভো এয়ারসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের গড়ে ১২ থেকে ২০টি করে ফ্লাইট আসা-যাওয়া করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ ধরনের উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হতে হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মিটার লম্বা এবং প্রস্থ কমপক্ষে ৪৫ মিটার। কিন্তু তিনটি বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ঠিক থাকলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার- যা প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ মিটার কম। পাশাপাশি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় রেসকিউ অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং (আরএফএফ) যান দুটি থাকার কথা থাকলেও আছে একটি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব নির্দেশনা না মেনেই সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এ তিনটি বিমানবন্দরে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরের আগে তিন বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ৭শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ শেষ না করেই বাজেটের ১৯০ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (এটিএস) নুরুল ইসলাম বলেন, ৩ বিমানবন্দরের রানওয়ের প্রস্থ বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে সিভিল এভিয়েশন। এখন যে প্রস্থ আছে তা দিয়ে যেসব এয়ারক্রাফটগুলো চলছে তাতে কোনো সমস্যা নেই। আইকাও পরিদর্শন করে তাদের পজেটিভ রিপোর্ট দিয়েছে।
সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে আইকাও’র (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন) পক্ষে একটি অডিট টিম এ তিনটি বিমানবন্দরের রানওয়ের মান পুরোপুরি ঠিক না করে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু তারপরও বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স এ মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে তিন বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যে উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে সেটিও ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ। তাদের মতে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে নিয়েও এ ধরনের সমস্যা আছে।
বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, বরিশাল বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮২৯ মিটার হলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার। দুর্ঘটনা মোকাবেলা অর্থাৎ অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে বিমানবন্দরটি তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত। এতে উদ্ধার যান রয়েছে মাত্র একটি এবং উদ্ধার ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৪৮ জনের। এছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও নেই বিমানবন্দরটিতে। একইভাবে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮২৯ মিটার হলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার। অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে বিমানবন্দরটি চতুর্থ শ্রেণীভুক্ত, যেখানে আরএফএফ যান রয়েছে একটি। একইভাবে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮০১ মিটার ও প্রস্থ ৩০ মিটার। এ বিমানবন্দরও অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে চতুর্থ শ্রেণীভুক্ত।
আইকাওয়ের মানদণ্ডে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানবন্দর তিনটি অনুপযোগী হলেও এতে অনুমতি দিয়েছে বেবিচক। সে মোতাবেক ফ্লাইটও পরিচালনা করছে বেসরকারি খাতের উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থাগুলো।
১৩ ফেব্রুয়ারি এ তিন বিমানবন্দরের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাটের অভিযোগে তদন্তের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেয়া হয় সিভিল এভিয়েশনকে। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মফিজুল ইসলাম পাটওয়ারী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘এই কর্মকর্তা ২০ বছর সিভিল এভিয়েশনের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন’। অভিযোগটি একজন সদস্য পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করে এর প্রতিবেদন ১ মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য বলা হয়। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের চিঠিটি দুর্নীতি দমন কমিশনেও পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ বলেন, এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্তের সুযোগ নেই। কারণ, বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। তিনি বলেন, কাজ করলে এমন অভিযোগ উঠবেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, তিন বিমানবন্দরের প্রয়োজনের তুলনায় ছোট রানওয়েতে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের অবতরণ ও উড্ডয়ন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, এসব বিমানবন্দরের রানওয়ের প্রস্থ প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ মিটার কম। ফলে ঘন কুয়াশা, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এমনকি আকাশে মেঘ বেশি থাকলে এ ধরনের উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে বৈমানিকদের মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়।