babulহবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে কিশোরী বিউটি আক্তারকে এক মাস আটকে রেখে ধর্ষণ এবং মামলা করায় ফের ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও অনেক। রাস্তাঘাটে নারীদের উত্ত্যক্ত করা, সখ্য গড়ে প্রতারণা ও অনৈতিক কাজের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানান, ভয়ে অনেক নারীই কোনও প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এই সুযোগে সে একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে গেছে।

মঙ্গলবার (২৭ মার্চ) বিকালে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

chardike-ad

স্থানীয়রা জানান, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে মৃত মলাই মিয়ার ছেলে বাবুল মিয়া (৩০) বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। ২০১০ সালে তার গ্রামের তৌহিদ মিয়ার মেয়ে সিলেটের এক প্রবাসীর স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পরও সে একাধিক নারীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং তাদের ব্ল্যাকমেইল করে অত্যাচার চালিয়েছে। রাস্তাঘাটে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করেছে।

ছেলের এসব অনৈতিক কার্যকলাপে তার মা ইউপি সদস্য কলমচান বিবির সায় রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। ছেলের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলমচানের কাছে বিচার দেওয়া হলে তিনি দায়সারা জবাব দিয়ে বিদায় করে দিতেন বলে জানান তারা।

সর্বশেষ গত ২১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের দিনমজুর সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এক মাস নির্যাতনের পর বিউটিকে কৌশলে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল। এ ঘটনায় গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পরে মেয়েকে সায়েদ আলী তার নানার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ১৬ মার্চ বিউটি আক্তারকে উপজেলার গুনিপুর গ্রামের তার নানার বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ফের ধর্ষণের পর তাকে খুন করে লাশ হাওরে ফেলে দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।

এদিকে বিউটিকে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে ১৭ মার্চ তার বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়াসহ দুজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর ২১ মার্চ পুলিশ বাবুলের মা কলমচান ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ঈসমাইলকে আটক করে। কিন্তু মূল হোতা বাবুলকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

বিউটির বাবা সায়েদ আলী বলেন, ‘বখাটে বাবুলের কারণে শুধু আমার মেয়েই নয়, এলাকার অনেক মেয়েই লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমার কিশোরী কন্যাকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে সে। অথচ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না। আবার উল্টো আসামিদের আত্মীয়স্বজনরা সমানে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার পুরো পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাস্তাঘাটে প্রায় সময়ই আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি একজন দিনমজুর, শ্রমিক মানুষ। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তান বিউটিকে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’

বিউটির মা হুসনে আরা বলেন, ‘বখাটে বাবুলের অত্যাচারে আমার মেয়েটাকে লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরে বন্দি অবস্থায় রেখেছি। কিন্তু এরপরও বাবুল কৌশলে আমার মেয়েকে অত্যাচার করেছে।’ তিনি আরও জানান, ‘বাবুল এলাকার উঠতি বয়সের তরুণী ও কিশোরীদের রাস্তাঘাটে পেলেই বাজে ভাষায় উত্ত্যক্ত করতো। কখনও কখনও গায়ে পর্যন্ত হাত দিয়ে যৌন হয়রানি করতো। তবে এলাকায় সে প্রভাবশালী হওয়ায় কারণে নিরীহ লোকজন কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।’ তিনি কন্যা হত্যার জন্য বাবুলকে দ্রুত গ্রেফতার ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের বাসিন্দা তাউছ মিয়া বলেন, ‘বাবুলের অপকর্মের কারণে গ্রামের নিরীহ মহিলারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বাবুল অনেক সময় এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে যুবতীদের নিয়ে এসে আড্ডার নামে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।’ পরিবারের সমর্থন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তাউছ মিয়া জানান, ‘বাবুল তার আত্মীয়স্বজনদের কথা শোনে না। এমনকি এলাকার মুরুব্বিদেরও তোয়াক্কা করেনি কোনোদিন। খারাপ হিসেবে চিহ্নিত লোকজনের সঙ্গে তার বেশ চলাফেরা। এলাকায় প্রায় সময়ই অপরিচিত লোকজনকে নিয়ে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায় তাকে। এলাকার চোর-ডাকাতদের নিয়ে বাবুল একটি দল তৈরি করেছে।’

একই গ্রামের বাসিন্দা ময়না মিয়া জানান, ‘বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বাবুল মিয়া যে একজন খারাপ লোক এটা এলাকার সবাই জানেন। কিন্তু এতদিন ভয়ে কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। আমরা বাবুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে সাহস না পায়।’

ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হোসাইন মো. আদিল জজ মিয়া বলেন, ‘বাবুল যে বখাটে একথা সত্য। এলাকায় তার অপকর্ম সম্পর্কে মানুষ বলাবলি করে। তবে বিউটিকে ধর্ষণ ও হত্যার আগে তার অপরাধের কথা এভাবে সামনে আসেনি। আমরা তার শাস্তি চাই। প্রশাসনিকভাবে যতটুকু সাহায্য করা দরকার আমরা করবো। বিউটির পরিবারকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, ‘বিউটি হত্যাকাণ্ডের দুই আসামিকে আটক করেছে পুলিশ। মূল হোতা বাবুলকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা বাবুলকে গ্রেফতার করতে পারবো। বাবুল যেখানেই থাকুক না কেন দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে আটক করা হবে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ঘাতক বাবুলকে গ্রেফতার করতে পুলিশের বিভিন্ন টিম কাজ করছে। যত দ্রুত সম্ভব বাবুলকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে তার আত্মীয়স্বজনরা যদি বাদীকে হুমকি-ধমকি দেয় তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

হবিগঞ্জের নারী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি ও নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট রুখসানা জামান বলেন, ‘গণমাধ্যমের কল্যাণে বিউটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি শুনেছি। এরকম অন্যান্য অপরাধ তো মানুষের চোখেই আসে না। একটি অসহায় কিশোরীকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনও ঘাতক গ্রেফতার না হওয়া হতাশাজনক। পুলিশ এখনও ঘাতককে গ্রেফতার করতে না পারায় রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে ঘাতক বাবুলকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা দরকার।’