বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম পরিবর্তনের বিষয়ে কঠিন নীতিমালা প্রণয়নের চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন। কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচয়পত্রে নাম পরিবর্তন করে অপরাধ সংঘটন মোকাবেলা করতে এই পরিকল্পনা। নতুন প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী, জন্ম নিবন্ধন সনদ ও মাধ্যমিক পরীক্ষার নিবন্ধন ফর্মে থাকা নামই জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকতে হবে। শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে এটি পরিবর্তন করা যাবে।
নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত দিক থেকে মানুষকে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “বিয়ের পর হিন্দু নারী তার স্বামীর গোত্রে অন্তর্ভুক্ত হন। তাই স্বামীর পারিবারিক পদবী বিবাহসূত্রে অর্জন করেন।”
“হাজার বছর ধরে চলে আসা এই রীতি পরিবর্তিত হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে।”দাশগুপ্ত মনে করেন অর্থনৈতিক, সামাজিক, আইনগত প্রভাবের পাশাপাশি ভোটাধিকারের মত মৌলিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে এই সিদ্ধান্ত।
“হিন্দু নারী স্বামীর পদবী ব্যবহার করতে না পারলে তার মধ্যে এমন আবেগ সৃষ্টি হতে পারে যেখানে পরিবর্তিত নামে ভোট দেয়া থেকেই বিরত থাকতে পারেন তিনি,” বলেন দাশগুপ্ত। দাশগুপ্ত মনে করেন এই আইন কার্যকর হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হবেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। আর এর ফলে নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশী।
“অধিকাংশ হিন্দু পরিবারেই নারীদের একক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না। স্বামীর সাথে যৌথ অ্যাকাউন্ট থাকে। অনেক হিন্দু নারী পিতার পারিবারিক সম্পদ পাওয়ার পর বিয়ে করেছেন এবং পরিবর্তিত নামেই সেসব সম্পত্তির নিবন্ধন হয়েছে। তাদের এখন নাম পরিবর্তন করতে হলে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হবে,” বলেন তিনি। তবে হিন্দু নারীদের মধ্যে এই আইন সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। নাম পরিবর্তনের বিষয়টিকে অনেকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলেও, অনেকেই এ-সম্পর্কে নিঃস্পৃহ।
নাম পরিবর্তনে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টির তীব্র সমালোচনা করেছেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন কোনো নাগরিক কি পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সামাজিক,অর্থনৈতিক ও আইনগত জটিলতার চেয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন বড়ুয়া।
“ব্যক্তির ভরণপোষণ, সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে থাকলেও তার কিছু ব্যক্তিগত বিষয় থাকে যেখানে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। একজন কি নামে পরিচিত হবে তা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তি কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় এবিষয়ে পৃথিবীর কোনো আইনই বাধা দিতে পারে না।” তবে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, এই আইনের বাস্তবায়ন এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনগত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেই নেয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। দাশগুপ্ত বলেন, এই সমস্যা প্রতিকারে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা উচিত সরকারের। বর্তমানে হিন্দু বিয়ের নিবন্ধন ঐচ্ছিক বলে জানান তিনি।