‘ইউনাইটেড হাসপাতালে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের ক্ষেত্রে যেসব রি-এজেন্ট (শনাক্তকরণ রাসায়নিক পদার্থ) ব্যবহার করা হয় সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই রোগীদের টেস্টের রিপোর্ট সঠিক হবে না।’ রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে অভিযানের পর র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন
বুধবার বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শেষে ইউনাইটেড হাসপাতালের লবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
এর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার, অননুমোদিত এজেন্ট থেকে ওষুধ ক্রয় এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
প্রসঙ্গত, বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ল্যাব ও ওষুধপত্রের মেয়াদ যাচাইয়ে অভিযান শুরু করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলার প্যাথলজি ল্যাব ও হেমাটোলজি ল্যাবের অবস্থান। এছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার কাছ থেকে ওষুধ আমদানি ও ক্রয় করে, রিজেন্টের মেয়াদ আছে কিনা- ইত্যাদি বিষয়ও যাচাই-বাছাই করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর আগে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ল্যাবে রোগ নির্ণয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার এবং ফার্মেসিতে প্রশাসনের অনুমোদনহীন ওষুধ রাখায় রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতাল ও ফার্মেসিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সারওয়ার আলম বলেন, হাসপাতালটির মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাব, বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাব, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি ল্যাব, হেমাটোলজি ল্যাবসহ সব ল্যাবে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ও উপকরণের পরীক্ষা করা হয়। এখানে যেসব রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মেয়াদ দুই থেকে চার বছর আগেই শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো দিয়ে টেস্ট করা হলে কোনো অথেনটিক (সঠিক) রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। সঠিক রিপোর্ট না পাওয়ায় অনেক সময় চিকিৎসক সঠিক রোগ নির্ণয়ও করতে পারেন না। পরবর্তীতে সঠিক রোগ ধরা না পড়ায় রোগীরা দেশীয় চিকিৎসার ওপর আস্থা হারাবে। পাশাপাশি রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগবেন। তাদের এ ক্ষতির পরিমাণ অনির্ণেয়। এছাড়া তাদের ল্যাবের রি-এজেন্টসহ যতগুলো কেমিক্যাল আছে সেগুলোর ৫০ ভাগের মেয়াদ শেষ হবে এপ্রিলে।
অভিযান সম্পর্কে সারওয়ার আলম আরও বলেন, সাধারণত প্যাথলজি ল্যাবের রেফ্রিজারেটরে দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে বিভিন্ন কেমিক্যাল সংরক্ষণের কথা, কিন্তু ফ্রিজের তাপমাত্রা সঠিক ছিল না। আমরা রি-এজেন্টের পাশে পানি জমে থাকতে দেখেছি।
নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আমদানি
সারওয়ার আলম বলেন, কয়েক বছর ধরে যে চেনের মাধ্যমে ইউনাইটেড হাসপাতাল ওষুধ কিনছে ওই মাধ্যম তাদের নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ করছে। যিনি ওই ওষুধ সরবরাহ করে তাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে ভুয়া কিউ-আর কোড এবং নতুন মেয়াদ বসিয়ে বিক্রি করেন বলে স্বীকার করেছেন।
অস্ত্রোপচারে ‘প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ’ সার্জিক্যাল সুতা ব্যবহার
সারওয়ার আলম বলেন, অভিযানে দেখা গেছে, হাসপাতালের অস্ত্রোপচারে যে সুতা ও সুচ ব্যবহার হয় তার মেয়াদ মাত্র সাতদিন বাকি। সেখানে উপস্থিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল অফিসার ড. মেহেদী বলেন, সার্জিক্যাল সুচাল বা সুতা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। এটা মানুষের শরীরে একসময় মিশে যায়। যেসব সুতা উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো ২০১৩ সালের তৈরি। মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র সাতদিন বাকি। এগুলোর মেয়াদ যত শেষের দিকে আসবে ততই ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের মুখে তালা
সরেজমিন বুধবারের অভিযানে দেখা যায়, ইউনাইটেডের ফার্মাসিতে থাকা অনেক ওষুধের গায়ে হাত দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা হয়েছে। বিদেশি ওষুধগুলোর কিউ-আর কোড স্ক্যান করেও পাওয়া যাচ্ছে না কোনো তথ্য।
অভিযানের সময় ইউনাইটেডের অনেক সিনিয়র চিকিৎসক উপস্থিত থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারেননি।
ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা ঘোষণার পর ইউনাইটেডের ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা কেউ কোনো জবাব দেননি। সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা নিচতলার ওপিডি-১ বিভাগের একটি কাচের রুমে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে কোনো কথা না বলে তারা চলে যান।