চীনের দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে দুই দশক আগে গভর্নর হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর এবার দেশটির নেতৃত্বে দেবতার আসনে যোগ দিলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অবাধ ক্ষমতার অধিকারী চীনের এ প্রেসিডেন্টকে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
প্রেসিডেন্টের নির্দিষ্ট মেয়াদ-সংক্রান্ত সংবিধানের সংশোধনীতে রোববার অনুমোদন দিয়ে শি জিনপিংয়ের ক্ষমতা আজীবনের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দেশটির রাবার স্টাম্প সাদৃশ পার্লামেন্ট।
পার্লামেন্টের এ অনুমোদনের ফলে ৬৪ বছর বয়সী শি যতদিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। ক্ষমতাসম্পন্ন সম্রাট হিসেবে দেশ শাসন করবেন। শুধু তাই নয়, কমিউনিস্ট এক অধিপতির মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হলো; যিনি নিজস্ব ভাবধারায় আধুনিক চীনের পুনর্গঠন করছেন।
গত বছরের অক্টোবরে চীনে কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেসে শি জিনপিং পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আপাতদৃষ্টে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বনে গেলেন শি। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের কাতারে নিজেকে নিয়ে গেলেন চীনের এ প্রেসিডেন্ট।
শি জিনপিংয়ের পিতা শি ঝংজুন ছিলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী নায়ক। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তবে চীনে সংস্কার আনতে মাও সেতুং যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন তাতে বাগড়া দিয়েছিলেন ঝংজুন। এর ফলে ১৯৬২ সালে দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কিছুদিন আগে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারণের পর কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।
এ কারণে রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শি জিনপিংয়ের রাজনৈতিক জীবনও হয়ে পড়ে কিছুটা কঙ্কটাকীর্ণ। শি জিনপিংই প্রথম কোনো চীনা নেতা যার জন্ম ১৯৪৯ সালের পর; যখন দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট বাহিনী দেশটির ক্ষমতায় আসে।
তার পিতার ক্ষমতাচ্যুতির গ্লানি পরিবারকে পোহাতে হয় দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে কাউন্টি পর্যায়ের সেক্রেটারি হিসেবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় শি জিনপিংয়ের। ১৯৯৯ সালে উপকূলীয় ফুজিয়ান প্রদেশের গভর্নর পদে অভিষিক্ত হন তিনি।
২০০২ ও ২০০৭ সালে ঝেজিয়াং ও সাংহাই প্রদেশের দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পান তিনি। ফুজিয়ান প্রদেশের দুর্নীতি ও অপরাধ নির্মূল করে দ্রুত সুনাম কুড়ান তিনি। ২০০৭ সালেই কমিউনিস্ট পার্টির পোলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন শি জিনপিং।
২০০৭ সালে দুর্নীতির দায়ে সাংহাই নগরীর পার্টি প্রধান চেন লিয়াংগু বরখাস্ত হন। আর এতেই কপাল খুলে যায় শি জিনপিংয়ের। চেন লিয়াংগুর স্থলে নিয়োগ পান তিনি। ২০০৮ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
মাও সেতুংয়ের বিপজ্জনক অর্থনৈতিক সংস্কার অভিযান ও ১৯৬৬-৭৬ সালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির পোলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তা ও নীতি-নির্ধারকরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা এড়াতে একটি নতুন ব্যবস্থা চালুর পক্ষে একমত হয়।
এর লক্ষ্য ছিল একক কোনো নেতার হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া ঠেকাতে সহায়তা করে। কিন্তু নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দূষণ, দুর্নীতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা অত্যন্ত চরম আকার ধারণ করে।
কিন্তু কমিউনিস্ট প্রচারণায় ‘শি দাদা’ (বড় চাচা শি) হিসেবে খেতাব পাওয়া শি জিনপিং ২০১৩ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গুঁড়িয়ে দিয়েছেন সব ঐতিহ্য। দুর্নীতিগ্রস্তদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন শুরু করেন। কয়েক দশক মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হওয়ার লক্ষ্যে দল পুনর্গঠনের আহ্বান জানান তিনি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও দলীয় নেতৃত্বই এখন তার কাছে প্রধান কাজ বলে ২০০০ সালে ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানান শি জিনপিং। ওই সময় এক হাজার কোটি ডলারের একটি কেলেঙ্কারির ঘটনার পর তিনি দেশ থেকে দুর্নীতি সমূলে উপড়ে ফেলার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক সংস্কার নাকচ করে দেন।
সেই সময় চীনের এই প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তিনি একটি দলীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক পরামর্শ ব্যবস্থা এবং গণমানুষের তত্ত্বাবধানে থেকে কাজ করবেন।’
শি জিনপিং বলেন, ‘গণমানুষের সরকার কখনোই জনগণের কথা ভুলে যায় না। জনগণের সেবার জন্য যা করা দরকার তার সবকিছুই অামরা করবো। কিন্তু একাজে সব সরকারি কর্মকর্তাকে পাওয়া সহজ হবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ভালো হবে না, আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি খুব বাজে কাজ করবে।’
দেশটির সব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় এখন ভরে গেছে শি জিনপিংয়ের মুখ। অনেক সময় চীনের এই প্রেসিডেন্টের বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ ও নির্দেশনা সংবাদের শিরোনামে আসে। প্রেসিডেন্ট থেকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান শি জিনপিংকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ শিরোনাম দেখা যায়। তবে বর্তমানে দেশটিতে তিনি ‘সর্ব বিষয়ের চেয়ারম্যান’ উপাধি পেয়েছেন।
সৌজন্যে- জাগোনিউজ