Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

workerবাংলাদেশে থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন, তার অর্ধেকেরও বেশি অদক্ষ। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা বলছে, প্রশিক্ষণের আধুনিক সুবিধা ও পর্যাপ্ত ট্রেনিং সেন্টার না থাকার কারণেই বিদেশে পাঠানোর মতো দক্ষ শ্রমিক তৈরি হচ্ছে না বাংলাদেশে।

দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে বেসরকারি উদ্যোগ কম থাকায় সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। যদিও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী বলছেন, দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য সরকারি যে সুযোগ-সুবিধা আছে তা যথেষ্ট।

chardike-ad

একবছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার এনামুল হক। দেশে কৃষি কাজ করলেও বাহরাইনে যাওয়ার পর এনামুল নিয়োগ পান একটি রড ও স্টিল কারখানায়। কিন্তু কাজ জানা না থাকায় সমস্যায় পড়েন তিনি। এরপর মাত্র দুই মাসের মাথায় দেশে ফিরে আসতে হয় এনামুলকে।

তিনি বলছিলেন, “ওখানে যে কারখানায় কাজ করতাম সেখানে ঝালাইয়ের কাজ হতো। স্টিল, রড কাটিংয়ের কাজ হতো। যারা কাজ করতো, তারা তো ১০/১২ বছর কাজ করে। তারা তো সব পারে। আমরা যারা নতুন ছিলাম, আমরা পারতাম না। এজন্যেই সমস্যা হয়েছে।”

বাংলাদেশ থেকে এনামুলের মতো যেসব অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে যান, তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট কোন কাজে বিশেষ দক্ষতা না থাকায় কম মজুরি, নিচু পদে কাজ করা এমনকি চাকরীচ্যুত হওয়াসহ নানারকম বিড়ম্বনায় পড়েন।

কিন্তু অদক্ষ শ্রমিকদের এভাবে আর কতদিন বিদেশে পাঠানো যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা’র সভাপতি বেনজীর আহমদ বলেন, “বিদেশি কোম্পানিগুলো সবাই এখন দক্ষ শ্রমিক চায়। আমরা যদি তাদের চাহিদা মতো ভবিষ্যতে দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে যারা এখন শ্রমিক নিচ্ছে তারা সেটা বন্ধ করে দেবে।”

“সেটা ৪/৫ বছরের মধ্যেই ঘটবে। কারণ, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য আমাদের চেয়ে বেশি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।” জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটি’র হিসেবে, ২০১৪ সালে বিদেশে যাওয়া মোট শ্রমিকের মাত্র ৩৪.৯৫% ছিলেন দক্ষ শ্রমিক। ২০১৫ সালে এটি হয় ৩৮.৫৬%। ২০১৬ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪২.০৮%। কিন্তু ২০১৭ সালে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর হার নেমে আসে ৩৩.৪৪%-এ।

জনশক্তি রফতানি বিশেষজ্ঞ তাসনীম সিদ্দিকের মতে, বাস্তবে দক্ষ জনিশক্তি পাঠানোর হার আরো কম। তিনি বলছিলেন, “বাংলাদেশ থেকে এখন নারী শ্রমিকদের ২১ দিন/২৮ দিনের ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। যেহেতু একটা ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, সেহেতু ট্রেনিং প্রাপ্তদের বিএমইটি’র পরিসংখ্যানে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে দেখানো হচ্ছে।”

“কিন্তু নারী শ্রমিকরা মূলত: যাচ্ছে গৃহকর্মী হিসেবে। আর তারা কিন্তু বিদেশে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃত নন। তাহলে বাস্তবে আমাদের কিন্তু স্কিলড মাইগ্রেশন একটুও বাড়ছে না।”

জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তত: ৩০টি সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য শ্রমিক চেয়ে থাকে বিভিন্ন কোম্পানি। সড়ক ও ভবন নির্মাণ, কাঠমিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিশিয়ান, তৈরি পোষাক, রেস্তোঁরা, গাড়ি চালনা, নার্স, গৃহকর্মী, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে লোক নিয়োগ দেয়া হয়।

বাংলাদেশেও দক্ষ শ্রমিকের জন্য নতুন নতুন চাহিদা আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু সে অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারছে না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এর কারণ জানতে চাইলে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা’র সভাপতি বেনজীর আহমেদ জানান, বিপুল সংখ্যক লোককে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে তোলার মতো অবকাঠামো বা সুযোগের অভাব আছে দেশে।

তিনি বলছিলেন, “সরকারিভাবে বিভিন্ন জেলায় ট্রেনিং সেন্টার আছে ৬০টির মতো। এগুলো যথেষ্ট না। আন্তর্জাতিক মানের ট্রেনিং সেন্টার আছে মাত্র ছয়টি। বাকীগুলোর মান দক্ষ শ্রমিক তৈরির উপযোগী না।” তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী বলছেন, দেশে ট্রেনিং এর যথেষ্ট সুযোগ আছে।

তিনি বলছিলেন, “অদক্ষ লোক বিদেশে যাচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু আমরা ট্রেনিং এর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ট্রেনিং দিচ্ছিও। এখানে অবকাঠামো বা সুযোগ-সুবিধার কোন ঘাটতি নেই। বরং বিদেশে যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেনিং গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে।”

বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক বেশি যাওয়ায় তারা নিয়োগ পাচ্ছেন অপেক্ষাকৃত নিচু পদে, কম বেতনে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রেমিটেন্সে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিকের মাধ্যমে রেমিটেন্সি এসেছে ১৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।

কিন্তু এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন একইসময়ে তাদের ৬৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পেয়েছে বাংলাদেশের দ্বিগুণ — ৩৩০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো যখন বেসরকারি উদ্যোগেই দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে নানারকম প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে, বাংলাদেশে তখন এক্ষেত্রে খুব একটা তোড়জোড় নেই।

বেসরকারি উদ্যোক্তারা কেন বিনিয়োগ করছেন না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সি. আর. আবরার বলছেন,”আমাদের এখানে অদক্ষ লোকদের মধ্যেই মূলত: বিদেশ যাবার প্রবণতা বেশি। তারা অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে যাবার জন্য তৈরি থাকেন। যার ফলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও দক্ষ বা অতি দক্ষ শ্রমিক না খুঁজে অদক্ষদেরই বিদেশে পাঠিয়ে থাকেন।”

“এখানে জনশক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উদ্যোগে সেভাবে ট্রেনিং সেন্টার খুলছে না। এখানে আসলে সরকারকেই প্রাথমিকভাবে বড়ধরণের উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রেনিং খাত যদি লাভজনক হয়, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে বিনিয়োগ করবে।”

তার মতে, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে, তা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু বাংলাদেশে এখনোএ ধরণের কোন উদ্যোগ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র- বিবিসি বাংলা