প্রবাসে আসার প্রবণতা সবেচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকদের মধ্যে কাজ করে। প্রবাসে এসে পরিবারকে বর্তমান সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলার চেষ্টা করা প্রথম লক্ষ্য বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যেতে কম হলেও ২ থেকে ৩ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ২/৩ লাখ টাকা একত্রিত করা কষ্টসাধ্য বিষয়। আমাদের দেশে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার জন্য টাকা মিলাতে অনেক কষ্ট হলেও ইউরোপ যাওয়ার জন্য ১৫ লাখ টাকা মিলানো খুবই সহজ। ইউরোপের ভিসা হয়ে গেছে শুনলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনেকেই টাকা দিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা হাতে পেয়েও টাকার মিল হয়না সহজে। মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকরা বাবার হালের বলদ বিক্রি করে, মায়ের স্বর্ণ বন্ধক রেখে, ভিটে বাড়ি বন্ধক রেখে, জমি বিক্রি করে, সুদে টাকা এনে আসে প্রবাসে।
প্রবাসে আসার মাধ্যমে শারীরিক পরিশ্রমের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মতের মানুষের সাথে বসবাস করতে হয় প্রবাসে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রকারের সংস্কৃতির দেখা মেলে। দেশ থেকে বহুদূর প্রবাস জীবন শুধুই যে কষ্টের সেটাও কিন্তু সঠিক নয়। প্রবাসে কিছু অর্জনের জন্য আসা আর সেই অর্জনে সামান্য কষ্ট হবে এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া প্রবাস হচ্ছে ত্যাগের জীবন এবং ত্যাগীর বাস। যে যত বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে সে তত সফল হতে পারবে। মা – বাবা, আত্মীয় স্বজন রেখে দূর প্রবাসে এসে যদি সফল হওয়া না যায় তাহলে প্রবাসে আসার সার্থকতা থাকেনা। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রবাসে নিজেকে পরিচালিত করতে হয়।
বর্তমান বিশ্বে চলছে অপসংস্কৃতির জয়জয়কার। সেই অপসংস্কৃতিতে আমাদের বাংলাদেশি প্রবাসী ভাইদের মধ্যে অনেকেই কিছুটা হলেও নিজের শরীর এবং মন ভাসাচ্ছেন। ত্যাগের প্রবাস জীবনকে বিলাসিতায় পরিণত করে ফেলেছেন। অপসংস্কৃতির ছোয়ায় পথভ্রষ্ট হচ্ছেন অনেক যুবক। পরিবারকে স্বচ্ছলতা এনে দিতে প্রবাসে আসা যুবক নিজেকে খারাপ পথের পথিক বানিয়ে ফেলছেন। একাকীত্বের প্রবাসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অন্যায় এবং ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছেন শত শত প্রবাসী। যার ফলে নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে ফেলছেন পাশাপাশি পরিবারের আশা ভরসা নির্মূল করে দেওয়া হচ্ছে। সর্বনাশা জীবন সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সমাজে একজন ব্যক্তি খারাপ পথের পথিক হলে তার সঙ্গী হয় সেই সমাজের আরও অনেকেই। সেই সাথে হারিয়ে যায় শত শত পরিবারের লালিত স্বপ্ন।
আমিরাতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের স্বল্প সংখ্যক প্রবাসী খারাপ পথের পথিক। প্রবাসীর প্রবাস যদি হয় সর্বনাশ তাহলে একজন প্রবাসীর সাথে পরিবারের অন্যরাও সেই সর্বনাশের ফল ভোগ করেন। সে জন্যই সন্তানকে প্রবাসে পাঠিয়ে প্রবাসীর পরিবার নিশ্চিন্তে থাকা একদম উচিৎ নয়। প্রবাসী সন্তানের জীবনযাপন সম্পর্কে তদারকি করতে হবে। বর্তমান আধুনিক যুগে দেশ থেকে প্রবাসীর তদারকি করা আহামরি কিছু নয় বরং অতীব সহজ। দিনে একবার নয় একাধিকবার যোগাযোগ করা সম্ভব। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরপ্রবাসী সন্তানের খবর রাখা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হয় খুবই জরুরী। মোবাইলে হাত দিয়ে টাচ করলেই খবর নেওয়া যায়। অডিও ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি প্রবাসী সন্তানের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায়। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য শিক্ষিত হতে হবে তাও কিন্তু নয়। কেউ যদি দু একবার দেখিয়ে দেয় মোবাইল ব্যবহার করা শিখে নেওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমানে স্বল্প খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। শুধু ইচ্ছে থাকলেই প্রবাসী সন্তানের সাথে প্রতিদিন যোগাযোগ করা সম্ভব।
মদ্যপায়ী কিছু প্রবাসীর ঘৃণিত জীবনযাপন নিজ চোখে দেখে আতঙ্কিত হয়েছি বলে এসব কথা লিখছি। কিছু যুবক প্রবাসে এসে মদ্যপানের মধ্যদিয়ে নিজ রক্তের বিনিময়ে উপার্জিত টাকা নষ্ট করে দিচ্ছে। বিয়ার নামের ড্রিংক দিয়ে তারা নেশার প্রথম শুরু করে। এমন কিছু প্রবাসী আছে বিয়ার পানে বাধা দিতে চাইলে বলে এটা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আরও বলে বিয়ার পান স্টাইল। বিয়ারের পরেই শুরু হয় ফেন্সিডিল, ইয়াবা, বিদেশী মদ। মদপান করে শুধু নিজের শারীরিক ক্ষতি করছে না; সঙ্গে পরিবারের জন্য কষ্টের কারণ হচ্ছে। প্রবাসী সন্তানকে নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যায় বাস্তবতার মুখ দেখে না। রক্তের বিনিময়ে উপার্জিত টাকায় মদপান করে কিছু প্রবাসী ভাই নিজের রক্তের সাথে বেঈমানি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে দেশের নাম খারাপ করছে। মদপান করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে পরিবেশ নষ্ট করছে।
বলা বাহুল্য ভিন্নদেশীয় মদ্যপায়ী ব্যক্তিদের সাথে অতিরিক্ত মাখামাখির ফলে কিছু বাংলাদেশি প্রবাসীরা নেশাখোর হচ্ছে। তবে এটাও সত্য যে, আরও কিছু বাংলাদেশি ভাই আছেন দেশ থেকেই নানান প্রকারের নেশায় আসক্ত। অনেকে অন্যদের দেখা দেখি নতুন মদপান করা শিখে মাতাল হয়ে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। মদ ব্যবসায়ীদের সাথে অনেকের বন্ধুত্ব রয়েছে যার ফলে মদপানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বিশেষ কারণে আজমান শহরে বসবাসরত এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। দুপুরের খাবার খেতে হয়েছিল বন্ধুর বাসায়। পরিতাপের বিষয় হলো বন্ধুর বাসায় দুপুরের খাবারের পর যে কান্ড দেখেছিলাম তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিন রুম বিশিষ্ট ভিলায় প্রায় ১৫ জন লোক থাকেন। আর সবাই বাংলাদেশি প্রবাসী। খাবার শেষে আমি হাত এবং প্লেট ধোঁয়ার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে চমকে গেলাম। রান্নাঘরে বসে দুই জন বাংলাদেশি ভাই বিয়ার পান করছে। যারা আমিরাতে আছেন তারা জানেন আজমান শহর মদের জন্য আলাদা শপ আছে যা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে এরকম ঘরে ঘরে উন্মুক্ত তা আমার জানা ছিলো না।
এসব দেখে বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম এরকম পরিবেশে সে কিভাবে রয়েছে। উত্তরে বন্ধু বলেছিলো কোম্পানির ফ্রি ঘর তাই অন্যত্রে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গেলো কয়েকমাস পূর্বে বাসার নিচে কয়েকজন বাংলাদেশি জড়ো হওয়া দেখে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একজনের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে অনেক রক্ত ঝরছে। কারণ জানতে চাইলে একজন আস্তে করে বললো মদ পান করে নিজে নিজেই ব্লেইট দিয়ে শরীর কেটে ফেলছে। কোনো এক ছুটির দিনে ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। বিকট শব্দ শুনে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি একজন বাংলাদেশি রান্নাঘরে রাখা থালা বাসন ছুড়ে মারছে। তাকে থামাতে চাইলে আরেকজন বাঁধা দিয়ে বললো সে মদ পান করেছে আপনি থামাতে গেলে আপনাকে ও মারতে পারে। তার কথা শুনে আমি সাহস পেলাম না সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
অল্পসংখ্যক মদ্যপায়ী প্রবাসীর জন্য সকল প্রবাসীর দুর্নাম মেনে নেওয়া যায় না। বিদেশের মাটিতে দেশের নাম খারাপ করবে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। সেজন্য পারিবারিক তদারকীর মাধ্যমে, প্রবাসী কমিউনিটির সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মদপান থেকে সরিয়ে আনতে হবে প্রিয় জন্মভূমির প্রিয় মানুষদের। অপসংস্কৃতির কালো থাবা থেকে আমাদের ভাইদের আমরাই পারি ফিরিয়ে আনতে। দেশের সম্মান রক্ষার্থে, দেশীয় ভাইকে নেশার হাত থেকে বাঁচাতে সকল সচেতন প্রবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। মদ ব্যবসায়ী ভারতীয়দের সাথে অতিরিক্ত মাখামাখি বন্ধ করাতে হবে। আন্তরিকতার সাথে মদ পানের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনতে হবে।
আমাদেরকে একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না; আমরা প্রবাসে আসছি বাবা-মা, ভাই-বোন আর স্বজনদেরকে একটু সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে। আমরা প্রবাসীরা প্রতিকুল পরিবেশে সময় অতিবাহিত করি। কুসুমাস্থিন্ন ফুলেল রাস্তায় আমাদের বিচরণ নয়। সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে হবে। আজ হয়তো দেহে শক্তি আছে তাই যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই নিজেকে জাহির করতে পারা যায়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে হয়তো একদিন আজকের সময়কে খুব মনে আসবে কিন্তু লাভ হবে না। হয়তো এমন একদিন আসতে পারে পরগাছা হয়ে লালিত জীবন কাটাতে হবে। সেটা নিশ্চিয় ভালো দেখাবে না। তাই বর্তমান সময়কে মূল্য দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয়ে প্রবাস জীবনকে অতিবাহিত করতে হবে।
আব্দুল্লাহ আল শাহীন, শারজাহ (আরব আমিরাত) থেকে