Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

footpathপ্রায়ই অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে আমি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হেঁটে বেড়াই। না, কোনো স্বাস্থ্যগত কারণে নয়; আসলে হেঁটে চলাচল করার ক্ষেত্রে রাজধানী শহর কতটা উপযুক্ত, সেটা মূল্যায়নের ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে মূলত এটি করি। ইদানীং পৌরসভা থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন— নগর পরিকল্পনাসংক্রান্ত সব আলোচনায় একটি শহরকে বাসযোগ্য, পরিবেশবান্ধব, জনগোষ্ঠীমুখী এবং যান্ত্রিক পরিবহনের ওপর কম নির্ভরশীল করার অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে ‘হাঁটাবান্ধবতা’কে জোর দিচ্ছে। এটি ইতিবাচক। তবে এটাও দুঃখজনক যে, ছোট হোক, বড় হোক, বাংলাদেশের শহরগুলোয় হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় ফুটপাত বেশির ভাগ সময় সংস্কারাধীন পর্যায়েই থেকে যায়।

একটি সুপরিকল্পিত শহর থাকলে আপনি কর্মস্থল, পার্শ্ববর্তী দোকান কিংবা বিদ্যালয়ে শিশুদের আনা-নেয়ায় পায়ে হেঁটেই চলাচল করতে পারেন। কেননা এ ধরনের শহর আপনাকে নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে পরিবেশ দূষণকারী ও গ্যাস পোড়ানো ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল করে না। ফলে আপনার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে হাঁটার যোগ্য একটি শহর এলাকায় বসবাসরত সাধারণ নাগরিকের ওজন জনসংখ্যাবহুল উপশহরে (যেখানে গাড়িভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ততার কারণে মানুষের কায়িক শ্রম হয় না বললেই চলে) বাসরত নাগরিকের তুলনায় ৬-১০ পাউন্ড কম।

chardike-ad


গবেষণায় আরো দেখা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের অংশ হিসেবে হাঁটলে আপন শহরের জন্য অধিক সহানুভূতি তৈরি হয়, যা আপনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিচ্ছন্ন রাখায় বা মুনাফা-প্রণোদিত আবাসন উন্নয়নের কারণে ঐতিহাসিক কোনো স্থাপনা ধ্বংসের সম্মুখীন হলে তার প্রতিবাদে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করে। নিজ শহর ও এর জনগোষ্ঠীকে কাছ থেকে জানার অন্যতম কার্যকর উপায় হলো শহরের কাছাকাছি থাকা ও হাঁটা। তাই শহরের বাসযোগ্যতা নির্ণয়ের একটি ভালো পরিমাপক এর ‘হাঁটাবান্ধবতা’।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকা এখনো হাঁটার উপযোগী শহর হতে পারেনি। কেন? এক্ষেত্রে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চাই। প্রথমত. এ শহরের ফুটপাতগুলো অধারাবাহিক, বিচ্ছিন্ন। ফুটপাতের একটি ধারাবাহিক লুপ ব্যবহার করে আপনি ‘এ’ পয়েন্ট থেকে ‘বি’ পয়েন্টে চাইলেও যেতে পারবেন না। ফুটপাতগুলো প্রায়ই ছোট ছোট দোকান, অবৈধভাবে স্তূপকৃত নির্মাণসামগ্রী, ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ ডাস্টবিন এবং উন্মুক্ত নালা দ্বারা বাধাগ্রস্ত থাকে। সবমিলে এখানে হাঁটা খুব মুশকিল।

দ্বিতীয়ত. দূষিত বাতাস, উত্কট গন্ধ এবং পরিচ্ছন্নতার ব্যাপক ঘাটতি শহরের রাস্তায় হাঁটতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে। নিম্ন আয়ের মানুষ— যারা ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াতকারীদের ৬০-৭০ শতাংশ— সত্যিই তারা নিরুপায়। অনাকাঙ্ক্ষিত এ শহরে হাঁটা হলো তাদের বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। এছাড়া থুথু ফেলার অত্যাচার তো আছেই। এসব অত্যাচার থেকে বাঁচতে আপনাকে যখন গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়, তখন আপনি সহজভাবে হাঁটতে পারবেন না। কেন এ দেশের মানুষ এ ধরনের বদভ্যাসে অভ্যস্ত, তার ওপর একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া দরকার।

তৃতীয়ত. সহপথচারীকে ধাক্কা না দেয়া ছাড়া জনাকীর্ণ ফুটপাতগুলোয় হাঁটা আসলেই কঠিন। ঢাকার ফুটপাতগুলো পথচারী ছাড়াও হকার, ক্ষুদ্র দোকানি, যাত্রী, ভিক্ষুক, টোকাই, পকেটমার ও পুলিশের মতো বিভিন্ন চরিত্র কর্তৃক অভিনীত একটি অদ্ভুত শহুরে নাটক। ‘সাইডওয়াক ব্যালটে’ বিখ্যাত নগর সমালোচক জেন জ্যাকবস ফুটপাতের জীবনকে যেমনটা বলেছেন— এটি নগরের মানুষকেন্দ্রিক শহুরে সংস্কৃতির প্রমাণ। তবে এক্ষেত্রে যেটি প্রমাণিত তা হলো, ফুটপাতে হাঁটা তখনই কেবল একটি চমত্কার শহুরে অভিজ্ঞতা, যখন সেখানে কিছু কার্যকর সংস্থা ও নাগরিক শৃঙ্খলা থাকে।

চতুর্থত. রাস্তার জীবন সাংঘাতিক মানসিক চাপ তৈরি করে। মানুষের প্রবল প্রবাহ, অপ্রত্যাশিত বন্ধ রাস্তা, দ্রুতগতির গাড়ি, লক্কড়-ঝক্কড় বাস ও হর্নের কানফাটা শব্দ— সবমিলে এখানে যাত্রী পরিবেশ অসহনীয়। সড়ক নিরাপত্তার অভাব প্রতিনিয়ত পথচারীদের ভয়ার্ত করে, তাদের চলাফেরা থমকে দেয়। এমনকি বাবা-মায়েরা সন্তানদের বাইরে যেতে দিতে ভয় পান।

এসব পর্যবেক্ষণে এটা বেশ স্পষ্ট, এ জনাকীর্ণ শহরে আমরা প্রতিনিয়ত এসব ঘটনার সম্মুখীন হই। কিন্তু ‘হাঁটাবান্ধবতা’ প্রসঙ্গে আরো কিছু পর্যবেক্ষণ এ আলোচনায় আসতে পারে; আর তা হলো— মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাঁটার প্রতি অনাগ্রহ। রাস্তায় হাঁটাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঠিক সম্মানজনক কাজ বলে মনে করে না। তাদের কাছে গাড়ির মালিকানাকে সামাজিকভাবে উচ্চপর্যায়ের আর হাঁটাকে নিম্নপর্যায়ের কাজ বলে মনে হয়। এজন্য ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি আসলে আমার সহকর্মী বা বন্ধুবান্ধব কাউকে সঙ্গে নিই না।

প্রাতঃভ্রমণকারীরা ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা নিছকই ফিট থাকতে পার্কগুলোয় ভিড় করে; কিন্তু ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর’ মানুষ সাধারণত কাছাকাছি কোনো দোকান, পার্শ্ববর্তী বাজার বা নিকটবর্তী চিকিৎসকের চেম্বারে হেঁটে যেতে ইচ্ছুক নয়। এর পেছনে কারণ কী হতে পারে? প্রথমত. প্রত্যক্ষ বা স্পষ্ট কারণ— সড়কে নিরাপত্তার অভাব এবং পথচারীদের অদ্ভুত আচরণ অনেককেই হাঁটতে নিরুৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত. মধ্যবিত্ত শ্রেণী পথচারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাকে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা পরিমাপকের নিচের দিকে বিবেচনা করে থাকে, যা আসলে নিতান্তই দক্ষিণ এশীয় মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। কোনো একসময় এ দেশে ঔপনিবেশিক প্রশাসক ও জমিদাররা ক্ষমতা ও উচ্চ সামাজিক পদক্রম বা মর্যাদা প্রদর্শনে সবসময়ই ঘোড়া বা হাতির পিঠে চড়ে বেড়িয়েছে। আজকের দিনের সামাজিক গতিশীলতা ও শ্রেণী পরিচয়ের পরিবেশেও অতীতের এ ধ্বংসপ্রাপ্ত মূল্যবোধ এখনো বোধহয় তার রেশ ধরে রেখেছে।

‘হাঁটাবান্ধবতার’ পথে অন্য প্রধান বাধা নারীর প্রতি পুরুষদের অনভিপ্রেত আচরণ। ঢাকার রাস্তায় হাঁটা নারীদের জন্য মোটেই সহজাত কোনো ঘটনা নয়। আমি এবং আমার স্ত্রী যেহেতু ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই ঘুরে বেড়াই, সেহেতু এটি বুঝতে পারি, চারপাশের পুরুষদের অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটপাতে হাঁটা নারীদের জন্য একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। ঢাকার সড়ক জীবন সাংঘাতিকভাবে পুরুষকেন্দ্রিক। একটি হাঁটার যোগ্য শহরে অবশ্যই নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অন্তর্ভুক্তি জরুরি। সড়কগুলো নারীবান্ধব করতে হলে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আসলে একটি উপভোগ্য শহর সম্পর্কে দূরদৃষ্টির অভাবই আমাদেরকে হাঁটার যোগ্য ফুটপাত নিয়ে সঠিকভাবে ভাবতে দিচ্ছে না। হাঁটার যোগ্য পরিসর বা স্থান কেবল ফুটপাত নয়। ফুটপাতের আশপাশে যদি মনোমুগ্ধকর স্মৃতিস্তম্ভ, ঐতিহাসিক দালান, সবুজ গাছপালা, নদী, বিল ও গতিশীল জনপরিসর থাকে, তাহলে হেঁটে বেড়ানো একটি আকর্ষণীয় শহুরে অভিজ্ঞতা হতে পারে।

গত বছর আমি ইতালির রোমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। সেখানে সারা দিন আমাকে ব্যস্ত থাকতে হতো। কিন্তু আমার স্ত্রীর হাতে ছিল শহরটিকে জানার জন্য অফুরন্ত সময়। ফুটপাত, ক্রসওয়াক, অসম পেভমেন্ট, দ্রুতগতির স্মার্ট কার প্রভৃতি ছাড়া রোমের ঘূর্ণায়মান সড়কগুলো মাঝে মধ্যে কিছুটা বিপজ্জনক ঠিক, কিন্তু রোম পথচারীদের জন্য এককথায় স্বর্গ। কারণ আপনি মনুমেন্ট থেকে মনুমেন্টে সহজে হেঁটে যেতে পারবেন। তাছাড়া সেখানে সুসমন্বিত মাস ট্রানজিটসহ প্রচুর হাঁটার যোগ্য ভ্রমণপথ রয়েছে। রোম কেবল পরিচ্ছন্ন ও চমত্কার হাঁটার অভিজ্ঞতা দেয় না, আমার স্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী— শহরটি পথচারীকে একজন নগর ইতিহাসবিদে রূপান্তর করে। কেননা প্রতিটি পদক্ষেপে আপনি দেখতে পাবেন রোমান টেম্পল, রেনেসাঁ পালাজো; আবার কখনো ঐতিহাসিক পিয়াজা। এটি বিস্ময়ের নয় যে, মানিক মিয়া এভিনিউসংলগ্ন ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটপাত পড়ন্ত বিকালে পথচারীদের সংসদ ভবনের একটি চমত্কার দৃশ্য উপহার দিতে পারে।

ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্য শহরগুলো হাঁটার উপযোগী করতে আমরা কী করতে পারি? প্রথমে এ মিথ দূর করতে হবে যে, শুধু ফুটপাতকে হাঁটার যোগ্য করাই সব। ফুটপাত যতটা নিরাপদ, আরামদায়ক, আকর্ষণীয় ও পথচারীবান্ধব হবে; ততই পরিবেশ, নগর জীবন, শ্রেণী কাঠামো, লিঙ্গ ও সামাজিক পরিচয়ের দিক থেকে ‘হাঁটাবান্ধবতা’কে ইতিবাচক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিণত করবে। একটি হাঁটাবান্ধব শহর তৈরিতে জরুরিভিত্তিতে আমাদের ট্রাফিক প্রকৌশলী, স্থপতি-পরিকল্পনাবিদ, মেয়র, নীতিনির্ধারক, নগর নৃতত্ত্ববিদ এবং সর্বোপরি সুনাগরিকসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। আলোচ্য উদ্দেশ্য অর্জনে আমাদের একটি জাতীয় ফুটপাত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত এবং কাজটি সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে সামাজিক প্রচারণাও জরুরি।

লেখক: আদনান মোর্শেদ স্থপতি
চেয়ারপারসন, স্থাপত্য বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

বণিকবার্তা এর সৌজন্যে।