এ যুগে এসেও চিঠির জন্য অপেক্ষা করি বললে কেউ বিশ্বাস করবে! তাও আবার নিজ দেশে নয়, ভিনদেশে এসে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই চরম ডামাডোলে চিঠির মত একটি প্রাগৈতিহাসিক মাধ্যম যে এখনও মহা আড়ম্বরে টিকে আছে, তাও আবার যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশ, নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তবে কি ফোন, মোবাইল মেসেজি, ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসবকিছুকে পেছনে ফেলে চিঠির রয়েছে অন্য কোনো আকর্ষণ!
আমাদের দেশের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত চিঠি লিখতেই জানে না। আমার সন্দেহ আছে বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সী প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ঠিক কতজন ছেলেমেয়ে জীবনে একবার ঐতিহ্যবাহী চিঠি বলতে যা বোঝায় তা লিখে পোস্ট অফিসে গিয়েছে স্বজন বা প্রিয়জনকে পাঠাতে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো চিঠির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে যে পরিমাণ আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, অক্ষরে অক্ষরে যেভাবে অনুভূতি সেঁটে দেওয়া যায়, তা অন্য কোনও যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যায় না।
অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল বর্তমান যুগে উন্নত দেশে হয়তো চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে আসার পর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখানে বরং অন্য ধরণের সব যোগাযোগ থেকে চিঠির সামাজিক গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে হয়। পাশাপাশি অফিসিয়াল গুরুত্ব তো রয়েছেই।
চিঠির মাধ্যমে যেভাবে হাজার বছরের সংস্কৃতি লালন বা সংরক্ষণ করা যায় তারই প্রমাণ পেয়েছি যুক্তরাজ্যের ডাক বিভাগের ইতিহাস থেকে। ইংল্যান্ডের ‘রয়েল মেইল’ হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ডাক বিভাগ। ১৫১৬ সালে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে প্রাচীন ডাক ব্যবস্থাটি চালু হয়। প্রথম থেকেই এটি রয়েল গ্রুপের অধীনে ছিল। ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘মাস্টার অব দ্য পোস্ট’। মূলত উন্নত সেবা নিশ্চিতেই ডাক বিভাগে এ পদ তৈরি করেন তিনি।
১৭১০ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘পোস্ট মাস্টার জেনারেল’। রয়েল মেইল সার্ভিস জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৬৩৫ সালে। আজকের দিনে এই রয়েল সার্ভিসের জন্য সারা পৃথিবীব্যাপী ডাক ব্যবস্থা এ পর্যন্ত এসেছে। ১৮৪০ সালে রয়েল মেইলের পোস্ট মাস্টারদের প্রথম ইউনিফর্ম চালু হয়।
প্রথম ডাকবাক্স চালু হয় ১৮৫২ সালে। রাস্তার পাশের অলিগলিতে তখন বসানো হয় এই পিলার পোস্টবক্স এবং দেয়ালবক্স। ধীরে ধীরে এই কোম্পানিটি শুধু মানুষের সেবা দিতে ও ব্যবসার জন্য অর্জন করে বিশ্বের সেরা পোস্টাল সার্ভিসের মর্যাদা।
হঠাৎ করেই লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে ‘রয়েল মেইল’ এর ২০১৩ সালে ধস নামে। কিন্তু নিজেদের সেবা পরায়নতার পরিচয় দিয়ে ২০১৫ সালে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় ‘রয়েল মেইল’। রয়েল মেইল পোস্ট-সার্ভিসের সাথে কুরিয়ার সার্ভিস অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। তাছাড়া চিঠি ও পার্সেলের আকার ও ওজনের উপর ভিত্তি করে চার্জ বা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সেবার উপর ভিত্তি করেও মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
ইংল্যান্ডের ভেতরে ডাকসেবা পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যেমন- রয়েল মেইল স্পেশাল ডেলিভারি, রয়েল মেইল সাইন ফর ফার্স্ট ক্লাস, রয়েল মেইল সাইন ফর সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস মেইল ও সেকেন্ড ক্লাস মেইল।
এছাড়া আর্ন্তজাতিক পোস্ট সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশানাল ট্র্যাক, সাইন, স্ট্যার্ন্ডাড ও ইকনোমি সেবা। তবে পোস্ট সার্ভিসের মতো পার্সেল সার্ভিসেরও বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন- গ্রান্টেড, সাইন ও স্ট্যার্ন্ডাড সার্ভিস। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্যান্য কার্গো ও পোস্ট সার্ভিসের তুলনায় রয়েল মেইল সার্ভিস সবার থেকে এগিয়ে আছে।
আমার দেখা মতে, ইংল্যান্ডে ডাক বিভাগ এখনো বেঁচে আছে শুধু ডাকপিওনদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য, যেখানে তারা রোদ-বৃষ্টি এমনকি তুষারপাত উপেক্ষা করে ঠিক সময়ে দরজার প্রান্তে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। আমরা স্যালুট জানাই তাদেরকে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের ডাকবিভাগ এখন মৃতপ্রায়। আধুনিক প্রযুক্তি তো বটেই সেবায় আন্তরিকতার অভাবেও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের ডাক বিভাগ। কেন যেন মনে হয়, চিঠি এমন একটি যোগাযোগ, ডাক সেবা যদি আন্তরিকতা ও ভিন্নমাত্রার আইডিয়া নিয়ে শুরু হয়, তাহলে আমাদের দেশেও এটির সোনালী অতীত ফেরানো সম্ভব।
লেখক: শাফিনেওয়াজ শিপু, লন্ডন থেকে
সৌজন্যে: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম