দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টকে ঘুষ প্রদান এবং দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড পাওয়া স্যামসাংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট লি জে ইয়ংয়ের দণ্ড মুলতবি করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার আপিল আদালত। বিভিন্ন মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করা ওই রায়ে আদালত জানান, তিনি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়া এর বিনিময়ে তিনি নীতিগত সহায়তা দাবি করেছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, এ দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে। খবর রয়টার্স, এএফপি ও বিবিসি।
দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় কনগ্লোমারেট স্যামসাংয়ের এ উত্তরসূরিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন দেশটির আদালত। পরবর্তীতে সিউলের উচ্চ আদালতে সাজা কমিয়ে আড়াই বছরে নিয়ে আসা হয়। সোমবার সে সাজা বাতিল করে দেয়া হয়, এতে লি জে ইয়ংকে আর কারাভোগ করতে হবে না। তবে আদালত আরো জানান, আগামী চার বছর তিনি প্রবেশন পিরিয়ডে থাকবেন। এ সময়ে তিনি বিচারকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে পারবেন না।
আদালত থেকে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ স্মার্টফোন ও মেমোরি চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়েছিলেন। তত্কালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে ও তার কাছের লোকজনদের চাপে পড়ে ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
৪৯ বছর বয়সী লি জে ইয়ং গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আটক রয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইয়নহাপ জানায়, তিনি ৩৫৩ দিন আটক ছিলেন। যে দুর্নীতি মামলায় লি আটক ছিলেন, সেটিতে জড়িত পড়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে। এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে উঠে আসে কীভাবে পরিবার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কনগ্লোমারেট ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে দুর্নীতির যোগসাজশ হয়ে থাকে।
লির সাজা মওকুফের বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে শিম জুং তাইক নামে এক লেখক বলেন, ‘এটি আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় কীভাবে রাজনীতিবিদরা যায় ও আসে কিন্তু স্যামসাংয়ের ক্ষমতা অক্ষত থাকে।’
দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ সমান আয় করে থাকে স্যামসাং। স্যামসাং ও এর করপোরেট কালচার নিয়ে একাধিক বই লেখা শিম আরো বলেন, ‘আমাদের এখনো সেই পুরনো মাইন্ডসেট রয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, যদি চেইবলদের ঠিক না রাখি। আর চেইবল ঠিক থাকবে না, যদি সেটি এর প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের কোনো সদস্যের নিয়ন্ত্রণে না থাকে।’ উল্লেখ্য দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবার মালিকানাধীন বড় বড় গ্রুপকে চেইবল বলা হয়।
স্যামসাং গ্রুপের অগ্রগন্য প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ইলেকট্রনিকস। লি ২০১৪ সাল থেকেই স্যামসাংয়ের মোবাইল ফোন ও চিপ বাজার দেখাশোনা করে আসছিলেন। ২০১৪ সালে তার বাবা লি গন-হি হার্ট অ্যাটাকে মূলতলি জে ইয়ং স্যামসাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
গেল বছরের মার্চে দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক জায়ান্টগুলোর সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার কাছের মানুষদের সন্দেহজনক সম্পর্ক তার পতন নিয়ে আসে। পাকের বিরুদ্ধে ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বলপ্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়, যদিও পাক সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন।
এদিকে গত আগস্টে দেশটির নিম্ন আদালতে স্যামসাং উত্তরসূরি লির বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়। আদালতের বিবরণীতে জানা যায়, তিনি তত্কালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে ও তার কাছের মানুষকে ৬৪ লাখ ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন, যাতে তিনি স্যামসাংয়ের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ মজবুত করতে পারেন। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী চে সুন-সিলের সঙ্গে বিতর্কিত সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে। চইয়ের কন্যার ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় ক্যারিয়ার গড়ার জন্য একটি ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন লি।
সোমবার আদালতে মামলাটির জ্যেষ্ঠ বিচারক চিয়ং হোয়াং সিক বলেন, ‘রাজনৈতিক শক্তির পরোক্ষ চাপে’ চইয়ের কন্যাকে ঘোড়া উপহার দিয়ে থাকতে পারেন। আদালত থেকে আরো বলা হয়, লিকে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
আদালতের রায়ে বাদী বা বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। রায়ের সময় লির মুখভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখা না গেলেও আদালত থেকে বের হওয়ার পথে মৃদু হাসি দেখা যায়।
কারাবাসের সময় তিনি কীভাবে পার করেছেন, এ নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। দেশটির বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানটির এ শীর্ষ কর্মকর্তা কারাগারে শারীরিক ব্যায়াম ও বই পড়ে কাটিয়েছেন। তবে কারাভোগের ফলে তিনি কিছুটা ওজন হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।