সৌদি আরবে পাড়ি জমানো নারীকর্মীদের মধ্যে এখনো অনেকে কষ্টের মধ্যে দিন পার করছেন। তবে দেশটিতে গিয়ে গৃহকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার এমন নারীশ্রমিকের সংখ্যা আসলে কত, ওই দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) জানাতে পারেননি।
এ দিকে নারীশ্রমিকদের সমস্যাগুলো যাদের দেখার দায়িত্ব তাদের মধ্যে কারো কারো দ্বারা নির্যাতিত নারীরা শেল্টারহোমের আশ্রয় শিবিরে আরেক দফা নিগৃহীত হচ্ছেন। তারা নারীদের সমস্যা দেখার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছাতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলরের (শ্রম) দক্ষতা নিয়েও অনেক নারী প্রশ্ন তুলছেন।
সম্প্রতি দেশে ফেরা একাধিক নারী ও সৌদি আরবে অবস্থানরত নারীশ্রমিকেরা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, সৌদি আরবে যাওয়ার পর কফিলের বাড়িতে তারা কিভাবে দিনের পর দিন সাংসারিক কাজের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব তথ্য বলার সময় কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা জানান, দূতাবাসের শেল্টারহোমে একটি মেয়ে ১ জানুয়ারি আত্মহত্যা করার কারণে শেল্টারহোমে আশ্রয় নেয়া ৫ শতাধিক নারীকর্মীর মধ্যে রাষ্ট্রদূতের হস্তক্ষেপে দুই থেকে আড়াই শ’ জন নারী দেশে ফিরতে পেরেছেন।
তবে এখনো গৃহকর্তার দায়ের করা মামলার জটিলতার কারণে শতাধিক নারীশ্রমিক কষ্টের মধ্যে সেখানে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। তারা আরো জানান, প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে নির্যাতিত নারীশ্রমিকেরা দূতাবাসের শেল্টারহোমে আশ্রয় নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্ গত সোমবার নয়া দিগন্তকে বলেন, শেল্টারহোমে যেসব নারীশ্রমিক আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেককেই ইতোমধ্যে টিকিট দিয়ে ও আউটপাসে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিদেরও দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকের নামে কফিলের মামলা-মোকদ্দমা আছে। তাই বিষয়টি একটু জটিল হয়ে পড়েছে। তারপরও আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি কিভাবে দ্রত তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়।
সৌদি আরবে যাওয়া নারীশ্রমিকদের মধ্যে কী পরিমাণ শ্রমিক সমস্যার মধ্যে আছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে যারা শেল্টারহোমে (সেফহোমে) আসছেন, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছাড়াও আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশে পাঠানো হচ্ছে।
এক গ্রপ পাঠানোর পর দেখা যাচ্ছে নতুন সমস্যা নিয়ে আবার কিছু মেয়ে সেফহোমে চলে আসছেন। তাই সমস্যা জর্জরিত মেয়েদের সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে এই সংখ্যা শতকরা ১ ভাগও না বলে জানান তিনি।
নাম পরিচয় না প্রকাশের শর্তে এক নির্যাতিত নারীশ্রমিক বলেন, আমি যে কফিলের বাড়িতে কাজ করতাম ওই বাড়ির গৃহকর্তা ও তার স্ত্রীর সন্তান ছিল ২০ জন। তাদের আবার ছেলে ও মেয়ের ঘরের সংসারের নাতি-পুতি মিলিয়ে আরো ২৫ জন সদস্য। সব মিলিয়ে পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৪৫ জন। অথচ সবার দেখভালের জন্য গৃহপরিচারিকা ছিল মাত্র ২ জন। আমি ছাড়া আর একজন ছিল অন্য দেশের। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দালাল যখন আমাকে সৌদি আরব নিয়েছিল তখন বলেছিল, তোমার ডিউটি হবে আট ঘণ্টা। বেতন পাবে ১১০০ রিয়াল। ওভার টাইমসহ বেতন হবে অনেক। কিন্তু যাওয়ার পর গৃহকর্তা আমাকে মাসে বেতন দিয়েছে ৮০০ রিয়াল। কিন্তু সংসারের কাজ করতে হয়েছে ভোর ৫টা থেকে প্রায়ই রাত ১-২টা পর্যন্ত।
পুরো বাড়িটা মহলের মতো জানিয়ে তিনি বলেন, নিচেই শুধু ১৬টি বড় বড় ঘর। উপরে ছিল এমনই। সব জায়গার কাজ আমাদের দু’জনকেই করতে হতো। এভাবে ওই বাড়িতে পৌনে ২ বছর কাজ করেছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক চেষ্টা করেছি পালাতে। পারিনি। পায়ে ঘা হয়ে গেছে। একটু ভুল হলেই বাপও মারত, পুতেও মারত। তাগো ভাষা বুঝি না। এর জন্যও মারত। তিনি বলেন, একদিন গৃহকর্তার ছেলে ও তার বন্ধুরা রাত ১টার দিকে মদ খেতে বসে। আমি কৌশলে ওই রাতে পালিয়ে দূতাবাসের শেল্টারহোমে চলে যাই। কিভাবে পালিয়েছিলাম সেই ইতিহাস অনেক লম্বা- জানিয়ে তিনি শুধু বলেন, শেল্টারহোমে যারা এখনো আছেন তারাও নানা সমস্যায় আছেন।
শুধু তিনি নন, তার মতো অনেকেই এখনো দেশটিতে গিয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন। এসব সমস্যার ব্যাপারে দূতাবাসের লেবার বিভাগের দায়িত্ব থাকলেও তারা সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নারীশ্রমিকেরা।
এসব প্রসঙ্গে জানতে লেবার কাউন্সিলর সারোয়ার আলমের সাথে যোগাযোগে করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে টেলিফোন লাইন কেটে দেন। যদিও লেবার কাউন্সিলরের ৩ বছরের মেয়াদ শেষ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, একটি দেশে লেবার কাউন্সিলরের ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশি। সেখানে নতুন লেবার কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়ার আগে অবশ্যই যেন শ্রমবান্ধব, অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেয়া হয় সেটি নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার নারীশ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৩ হাজার নারীই গেছেন সৌদি আরবে।