Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

basic-bankচাকরির আবেদনের আগেই নিয়োগপত্র দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। এমন সৃষ্টিছাড়া ঘটনার কারণ হচ্ছে, নিয়োগে বেধড়ক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। নিয়োগ-সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে কখনও বিজ্ঞপ্তি ছাড়া, কখনও নিয়োগ পরীক্ষার নিয়ম লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ২০১২-১৩ সালে ১ হাজার ১৭৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসেছে।

এই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকটিতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের আওতায় থাকা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর কার্যকালের মেয়াদে। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন।

chardike-ad

সূত্র জানায়, বাচ্চুর সময়ে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের পাশাপাশি নিয়োগ-দুর্নীতি হয়েছে উচ্চমাত্রায়। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ওই নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বেতন-ভাতা খাতে আর্থিক বিষয়েও নানা অনিয়ম হয়েছে।

সিএজি সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ সালের নিয়োগ নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে ২০১৪ সালে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয় সিএজি কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়। এর কপি বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছেও পাঠানো হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া, শিক্ষাগত সনদে একাধিক তৃতীয় শ্রেণি থাকা ও চাকরির বয়সসীমা পার হওয়া সত্ত্বেও স্বাক্ষরবিহীন জীবনবৃত্তান্তের ভিত্তিতে ও ঘরোয়াভাবে নেওয়া লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রে অতিরিক্ত নাম্বার দিয়ে অদক্ষ, অনভিজ্ঞদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। ওই সব উত্তরপত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নেই।

ব্যাংকটির এমডি মুহম্মদ আউয়াল খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ধরনের অনিয়মে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিন জানান, সবেমাত্র এক মাস হলো তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। সংশ্নিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে অনিয়মগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে।

বেসিক ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ওই ১ হাজার ১৭৩ জনের মধ্যে কর্মকর্তার সংখ্যা ৮০১ জন। অফিস সহকারী, গার্ড, পত্রবাহক ও গাড়িচালক ৩৭২ জন। তৎকালীন চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় নিয়োগগুলো হয়েছে। উৎকোচ গ্রহণ করা হয়েছে কি-না তা তদন্তসাপেক্ষ।

অনিয়মের বহর: সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ) মোছাম্মত নাজমা খানম ১৯৮৭ সালে এসএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি, ১৯৮৯ সালে এইচএসসিতে তৃতীয় শ্রেণি, ১৯৯১ সালে স্নাতকে তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। এরপর বিয়ে ও কয়েক বছর সংসার করে দেশের হাজারো মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে বঞ্চিত করে লোভনীয় বেতনে চাকরিতে যোগদান করেন। এ যেন কল্পনার রাজ্যকেও হার মানায়। আবেদন পেশেরই অযোগ্য নাজমা খানমকে ৪০ বছর ২ মাস বয়সে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফাইলে তার কোনো আবেদনপত্র নেই। জীবনবৃত্তান্তে স্বাক্ষর নেই। ঘরোয়াভাবে নামকাওয়াস্তে তৈরি করা লিখিত পরীক্ষার খাতায় ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই, তারিখ নেই। নাজমা খানমের জন্ম ১৯৭২ সালের ১৬ জুন। তিনি যোগদান করেন ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসকে সাজেদুল হকের সহকারী কর্মকর্তা পদে যোগদানকালে বয়স হয়েছিল ৫১ বছর ১১ মাস। তিনি ওই পদে যোগ দিয়েছিলেন ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তার জন্ম তারিখ ১৯৬৩ সালের ২ অক্টোবর। ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতায় একাধিক তৃতীয় শ্রেণি। তার ক্ষেত্রেও চাকরির আবেদন ছাড়া ঘরোয়া পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষার খাতায় কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই।

একইভাবে চাকরির আবেদন, জীবনবৃত্তান্ত ছাড়াই ঘরোয়া পরিবেশে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে অতি মূল্যায়ন করে কাল্পনিকভাবে বেশি নাম্বার দিয়ে অফিসার পদে চাকরি দেওয়া হয় মো. আজগর আলীকে।

অফিসার পদে চাকরি পাওয়া মো. শাহাদৎ হোসেন চাকরির আবেদনপত্র জমা দেননি। জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় পরের দিন ২৪ ডিসেম্বর। জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার একদিনের মাথায় লিখিত পরীক্ষা নিয়ে খাতা মূল্যায়ন করে, ফল প্রকাশ করে কীভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলো তা বোধগম্য নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ব্যাংকের নিয়োগ নীতিমালা লঙ্ঘন করে একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মোট ৭৩১ কর্মকর্তাকে। অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ওইসব কর্মকর্তাকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সুপারিশে চাকরি: নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামের সুপারিশে ব্যাংকের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে ২৮ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অফিসার পঙ্কজ চন্দ্র দাসের ফাইলে দেখা যায়, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। তার আগেই ওই বছরের ২১ জুলাই বেসিক ব্যাংকে তার যোগদানের তারিখ উল্লেখ আছে। এমডির সুপারিশের দিনেই নিয়োগ-সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার চাকরির বয়সসীমাও অতিক্রান্ত হয়েছিল।

২০১৩ সালের ৯ জুন এমডির সুপারিশের দিনেই সহকারী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয় সাদরিনা আইরিনকে। সহকারী কর্মকর্তা রাসেউল আযম জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই, তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে আগের দিন ২৩ জুলাই।

আবেদনের আগেই: প্রতিবেদনে আবেদনপত্র পেশ করার আগেই বিভিন্ন পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৩ জনের নাম উল্লেখ আছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না থাকলেও কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়া তানিয়া সুলতানা নিয়োগপত্র পান ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ। কয়েক দিন পরে ৪ এপ্রিল তিনি শুধু জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন।

সহকারী কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক, মাহফুজা বেগম, আমিনুর রহমান, সোহাগ হাজরা, রণজিত রায়, মনোয়ারা খাতুন, মহিদুল ইসলাম, এমএম কাইয়ুম হাসান, আয়োতি নাহার, মো. নিজাম মিয়া, সালমা আকরাম ও শনিতা ইয়াসমিনকে আবেদনপত্র পেশ করার আগেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। এ রকম রয়েছেন ২৯ জন জুনিয়র অফিসার।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে মনগড়া তথাকথিত স্কাউটিং পদ্ধতিতে ২৮৭ গার্ড ও মেসেঞ্জার, ৬৯ গাড়িচালক ও ১৬ অফিস সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরে তাদের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাংকের শাখায় নিযুক্ত করা হয়।

পদোন্নতির অনিয়ম: বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগবিধি অনুযায়ী দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা থাকলেও ওই সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন পদে ২২ কর্মকর্তাকে ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ব্যাংকের বর্তমান উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কনক কুমার পুরকায়স্থের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নীতিমালা মানা হয়নি। তাকে জিএম পদে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর ও ডিএমডি পদে ২০১১ সালের ১০ মে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী জিএম পদে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২৫ বছর চাকরির বয়স হলে ডিএমডি পদে পদোন্নতি দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে তিনি জিএম পদে ১ বছর ৬ মাস ২০ দিন কর্মরত ছিলেন। জিএম পদে থাকাকালে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানও ছিল না।

নীতিমালার বাইরে পদোন্নতি পাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে কনক কুমার পুরকায়স্থ সমকালকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে যা বলার কর্তৃপক্ষ বলবেন।’

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তখনকার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে পছন্দের কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করেছে বলে উল্লেখ রয়েছে।

সৌজন্যে: সমকাল