সিউল, ১৬ অক্টোবর ২০১৩:
কোরিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে চিকিৎসকের ভুলে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলেন ইমরান। ডাক্তাররা বলছেন সৃষ্টিকর্তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ব্যতীত ইমরানের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশী তরুণ যুবক ইমরান হোসাইন (৩৪) বর্তমানে সিউল রিহাব এন্ড জিরিয়াট্রিক হসপিটালে চিকিৎসাধীন আছেন।
গত এক বছর ধরে হাসপাতালই ইমরানের ঘরবাড়ি। নিজের শরীর নিয়ে কঠিন একটি সংগ্রামের মাধ্যমে দিন পার করছেন। পা থেকে কোমর পর্যন্ত তেমন বোধশক্তি নেই। হাতও বলতে গেলে অবশ। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও কষ্ট হয়। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কাজ সারতে হয় বিছানাতেই।
৭মাস ধরে এই সিউল রিহাব এন্ড জিরিয়াট্রিক হসপিটালে কোন চিকিৎসা ছাড়া শুধু থেরাপি দিয়ে কোনমতে বেঁচে আছেন। কয়েকমাস ধরে হাসপাতালের খরচও বকেয়া। কয়েক বছরে যা আয় করেছিলেন তার সবই খরচ করেছেন চিকিৎসার পিছনে। আইবিকে ব্যাংক (IBK BANK) এক কোটি উওন আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল যা দিয়ে আগের হাসপাতালগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় উন্নত চিকিৎসা না হলে পুরো শরীর অকেজো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উন্নত চিকিৎসার জন্য কোরিয়ার এইচআরডি’র কাছে লিখিতভাবে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু তারা দোভাষী দিয়ে সহযোগিতা ছাড়া অন্যকোন সাহায্য করতে পারবে না বলে জানিয়েছে তারা।
যেভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হলেন ইমরান
২০১১ সালে কোরিয়ায় আসেন ইমরান। এসে কাজ শুরু করার কিছুদিন পর কারখানায় আঘাত পান। আঘাত পাওয়ার পর থেকেই ইমরান পিঠে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য ইমরান বেশ কয়েকবার উইজংবু’র বিখ্যাত সংমো হাসাপাতালে যান। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে থাকেন। কিছুদিন পরেই ডাক্তার ইমরানকে জানান তার এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হলে অপারেশন করা দরকার। ইমরান অপারেশন ছাড়া অন্য কোন উপায়ে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে তাগাদা দেন। কিন্তু ডাক্তার প্রতিবারই বলতে থাকেন এই অপারেশন না করলে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন তিনি। ভয় পেয়ে বসে ইমরানের। ডাক্তারের কথায় অপারশনের সিদ্ধান্ত নেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন।
ইমরানের ভাষায় “ ১৭ সেপ্টেম্বর আমাকে সন্ধ্যার দিকে ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় এবং গভীর রাত পর্যন্ত তিনবার অপারেশন করে। সারারাত আমি সংজ্ঞাহীন ছিলাম। ঐ রাত থেকেই আমি পঙ্গু। হাত পা কিছুই আর কাজ করেনা। ঐ ডাক্তার আমার জীবনটা শেষ করে দিল”।
মামলায় জিতলে ডাক্তারের সনদ বাতিল হবে
সংমো হাসপাতালে ৪মাস থাকার পর সিউলের আইসিএল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন ইমরান। পরবর্তীতে সিউলের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর সেখানকার ডাক্তার আগের ডাক্তারের ভুল অপারেশনের কথা উল্লেখ করে রিপোর্ট দেন। ঐ রিপোর্ট নিয়েই মামলা করেন ইমরান। ভুল চিকিৎসার জন্য ঐ ডাক্তারের সর্বোচ্চ শাস্তি চান ইমরান। মামলায় জিতলে ঐ ডাক্তারের সার্টিফিকেট বাতিলসহ বিশাল অংকের জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মামলা শেষ হতে প্রায় এক বছর লাগতে পারে বলে জানান ইমরানের আইনজীবী।
একাকীত্ব জীবন
ইমরান বাবা মাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। তিনবোন আর একভাই দেশে বসবাস করছেন। তিন বোনেরই বিয়ে হয়েছে। ছোটভাই জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। নিজের এই খারাপ সময়ে ভাইবোনদেরকে কষ্ঠ দিতে চান না ইমরান। তাই কোরিয়ায় চিকিৎসা শেষ করতে চান। ইমরান বলেন “বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। এই বোনগুলো ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি দেশে গেলে তাদের সংসারে সমস্যা হতে পারে। তাই দেশে যেতে চাই না। দেশে যাওয়ার চেয়ে কোরিয়াতে থেকে লড়াই করে যতদিন বেঁচে থাকা যায়”।
হাসাপাতালে একাকীত্ব নিঃসঙ্গ দিন কাটে ইমরানের। শরীরের সাথে যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। হাসপাতালে কথা বলার একজন মানুষও নেই। ইমরান জানান “ বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন ভাই মাঝেমধ্যে এসে দেখে যান। ভিনদেশে এতটুকুই আমার কাছে অনেক বেশি”।
বাংলাদেশে ইমরান পেশায় ছিলেন মার্চেন্ডাইজার। গাজীপুরের একটি গার্মেন্টসে সম্মানজনক চাকরি ছেড়ে কেন কোরিয়া এসেছেন জিজ্ঞেস করলে ইমরান জানান বিদেশ আসার শখের কথা। ছোটবেলা থেকে বিদেশ যাওয়ার সপ্ন ছিল। এই সপ্ন থেকেই কোরিয়া এসেছিলেন ইমরান।