গত ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি চূড়ান্ত হিসাবে নাকি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ ডলারে। সরকার রাজনৈতিক কারণে এ দুটো পরিসংখ্যানকে বাড়িয়ে দেখায় বলে সমালোচকরা প্রায়ই অভিযোগ করে চলেছেন। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান দুটোকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে না। সেজন্য এ দুটি সংস্থার প্রকাশিত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু জিডিপি বেশ খানিকটা কম দেখানোই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাদের তো পরিসংখ্যান সংগ্রহের তেমন কোনো ভালো বিকল্প ব্যবস্থা আছে বলে আমাদের জানা নেই। ওই ধরনের পদ্ধতিগত ক্ষমতা না থাকলে প্রতিষ্ঠান দুটি কীভাবে তাদের নিজস্ব বিকল্প পরিসংখ্যানে উপনীত হচ্ছে, তা তারা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করছে না। অতএব, তাদের এই পাল্টা দাবিও যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে এ দেশের ক্ষমতাসীন সরকার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পছন্দসই সরকার কিনা, পরিসংখ্যান সম্পর্কিত এ বিতর্ক অনেকটাই তার ওপর নির্ভর করছে বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। তাই আমি এ বিতর্কে পক্ষ নিতে রাজি নই। যদি পরিকল্পনামন্ত্রীর দাবি সত্য হয়, তাহলে পাঠকদের একটা সুসংবাদ দিতে পারি যে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে।

chardike-ad

দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বহুদিন থেকেই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছিলেন যে, বেশ কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের নানা সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে, বাকি ছিল শুধু মাথাপিছু জিডিপি। এবার এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পেছনে ফেলে দিল পাকিস্তানকে। তাই এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের জন্য আরেকটি বিজয়গাথা রচনা করেছে বলা চলে। কারণ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানকে যেভাবে শোষণ, লুণ্ঠন, চরম বৈষম্যমূলক উন্নয়ন-বরাদ্দ ও ব্যাংকঋণ বরাদ্দ এবং পুঁজি পাচারের অসহায় শিকারে পরিণত করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে ধাপে ধাপে ওই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তর করেছিলাম আমরা। ওই স্বাধীনতার সংগ্রামকে নারকীয় গণহত্যা চালিয়ে স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার কারণেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জাতি। আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই যে, পাকিস্তানের ২৪ বছরের এই নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জিঞ্জির ছিন্ন করার জন্য বাঙালি জাতিকে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদানের শাহাদত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মতো চড়া দাম চুকাতে হয়েছে। তাই বলছি, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতি যে বিজয়ের গৌরবে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যাত্রা করেছে, তার একটি মাইলস্টোন অর্জিত হলো ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এই ঐতিহাসিক অর্জনের মাধ্যমে। পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে মোতাবেক ১৯৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৯ দশমিক ৮০ ডলার, আর পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৪০ ডলার। তার মানে, পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় তখন পূর্ব পাকিস্তানের আড়াই গুণ বেশি ছিল। প্রায় ৪৬ বছর পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মাথাপিছু জিডিপির প্রতিযোগিতায় আমরা পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে হারিয়ে দিলাম এ বছর। এবারের আসন্ন ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে আমরা যেন এ সুখবরটাও যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বকে জানাতে চেষ্টা করি, তার জন্য সরকারের কাছে আকুল আহ্বান জানাচ্ছি।

পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ হিসেবে পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার ইতিহাস যেন আমরা কখনই না ভুলি: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসক মহলের সঙ্গে বাঙালিদের প্রথম প্রকাশ্য বিরোধটা শুরু হলেও এর আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যেকটা প্রাথমিক অর্থনৈতিক নীতিতে পূর্ব বাংলার ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার সংঘবদ্ধ প্রয়াসটা দৃষ্টিকটুভাবে ধরা পড়ে যাচ্ছিল বারবার। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে যাওয়া প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার প্রয়োজনকে প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল প্রথম থেকেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজধানী করাচিতে সরকারের দপ্তরগুলোর ইমারত নির্মাণ, সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জরুরি প্রয়োজন এবং মোহাজেরদের পুনর্বাসনের জন্য বিপুল ব্যয়ের ইস্যুগুলো। এভাবে যে বঞ্চনার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও নীতি-বাস্তবায়ন শুরু হলো, তার শেষ হয়নি পাকিস্তানের পুরো ২৪ বছরে। পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৫১ সালে। ওই আদমশুমারিতে পাকিস্তানের জনসংখ্যা নির্ণয় হয় ৭ কোটি ৫৮ লাখ, যার মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ ছিল পূর্ব বাংলার, মানে ৫৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। (১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলার পরিবর্তিত নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান, কারণ টু ইউনিট ভিত্তিতে পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হয়েছিল।) ওই জনসংখ্যার আনুপাতিক ন্যায্য হিস্যা কোনো ব্যাপারেই পূর্ব পাকিস্তান ২৪ বছরে কখনই পায়নি, এমনকি ওই হিস্যা গড়ে তার অর্ধেকে, মানে ২৮ শতাংশেও পৌঁছেনি। নিচের তথ্যগুলো দেখুন:

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রফতানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রফতানি আইটেমগুলো থেকে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কোরিয়া যুদ্ধ ও প্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে পূর্ব বাংলার পাট রফতানি আয়ে একটা জোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় ওই অনুপাত ৮০-৮৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ ওই রফতানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিয়ে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রফতানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান ক্ষুদ্রাংশ পূর্ব পকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনই বছরে রফতানি আয়ের এক-চতুর্থাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি। রফতানি আয়ের ১৫-২০ শতাংশের মতো পূর্ব বাংলাকে বরাদ্দ করাই ছিল পঞ্চাশের দশকের নিয়ম, এমনকি এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। ২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়ে গিয়েছিল। ২৪ বছরে ওই ‘বৈদেশিক সাহায্যে’র মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, এটা ওসব দাতা দেশ ও সংস্থার হিসাব মোতাবেকই প্রমাণিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল ওসব দাতারা নতুন করে বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু ৫৫ শতাংশের বাকি ৩৮ শতাংশ কি বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা ছিল না? ৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগকারীরা ঋণ হিসেবে পেয়েছেন, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কব্জা করে নিয়েছেন। ৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। ৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। ৫৫ শতাংশের বাকি ২৬ শতাংশ কি বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা ছিল না? ৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোয় পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছেনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্প-কারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্প-কারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না। ব্যাংকঋণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এসব শিল্প-কারখানা কী ধরনের বঞ্চনার সাক্ষ্য বহন করছে? ৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। এমনকি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনাদানা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ওই অর্থ, সোনাদানা ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কত ছিল, তার হিসাব এখনো পাওয়া যাবে। ৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা। ১০. যখন ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার। আর এমনিতেই ওই পর্যায়ে পাকিস্তানের সরকারি দখলে থাকা সব সম্পদের ন্যায্য হিস্যা তো বাংলাদেশের পাওনা রয়েই গেছে। ১১. ২৪ বছরে পাকিস্তান তিন-তিনটি রাজধানী নির্মাণ করেছে। পাকিস্তানের তিনটি রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ নির্মাণ ব্যয়ের মোট পরিমাণ কত, তা কখনো নির্ণয় করা হয়নি। ১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখা নদীগুলোয় বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য ‘ক্রুগ কমিশনের’ রিপোর্ট বাস্তবায়ন করার কোনো প্রয়াসই নেয়নি অর্থায়নের অভাবের কথা বলে। উক্ত সেচ ব্যবস্থার কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় আনা হয়েছিল।

এ পর্যায়ে পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে উপরে রয়েছে এবং ক্রমে এই দুই দেশের অবস্থানের পার্থক্য বেড়েই চলেছে। মানে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে মানব উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় সামনে এগিয়ে গেছে। পাঠকদের জানাই, মানব উন্নয়ন সূচক হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কতখানি ভালো বা খারাপ করছে, তার একটি বহুল-ব্যবহূত বিন্যাস পদ্ধতি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন কনসেপ্ট entitlement & capabilities ধারণা দুটোকে অনুসরণ করে পরিমাপযোগ্য উন্নয়ন সূচকের প্রক্সি হিসেবে পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবুল হক এ ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ উদ্ভাবন করেছেন, যেটাকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর তাদের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এ বিন্যাস বা র্যাংকিং নির্ধারিত হয়— ১. ক্রয়ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে প্রাক্কলিত জিএনআই (গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম), ২. গড় আয়ু এবং ৩. গড় স্কুল গমনের বছর ও প্রত্যাশিত স্কুল গমনের বছরের ভিত্তিতে প্রাক্কলিত শিক্ষা সূচক। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ মানব উন্নয়ন সূচকের যে সর্বশেষ কান্ট্রি-র্যাংকিং প্রকাশ হয়েছে, তাতে ২০১৫ সালের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৯ নম্বরে। আর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ১৪৭ নম্বরে। এ দুটো অবস্থানই মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন সূচক নির্দেশ করছে, কিন্তু বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৫৭৯ আর পাকিস্তানের স্কোর মাত্র শূন্য দশমিক ৫৫, যেটা মধ্যম ক্যাটাগরির সর্বনিম্ন স্কোর। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ২০১৬ সালে ছিল ৭২ বছর, আর পাকিস্তানের জনগণের গড় আয়ু ছিল ৬৬ দশমিক ৪ বছর। স্বাস্থ্যের বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছে। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ভারতের জনগণের চেয়েও বেশি, ভারতের গড় আয়ু ৬৭ বছর। মানব উন্নয়নে পাকিস্তান খারাপ করার প্রধান কারণ হলো, ৬ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা ও সিপাহি নিয়ে পাকিস্তানের যে বিপুল সশস্ত্র বাহিনী পুষতে হচ্ছে, তার ব্যয় নির্বাহ করার বোঝাটা পাকিস্তানের জন্য অসহনীয় বোঝা হিসেবে কাঁধে চেপে বসে থাকলেও দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় অদূর ভবিষ্যতে কমাতে পারবে না; যার ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা মানব উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য অন্যান্য খাতে পাকিস্তানের সরকার তেমন একটা অগ্রাধিকার দিতে পারছে না।

১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি এই বর্বর পাঞ্জাবিদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এ জাতির ‘অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম’ সফল করার জন্য আমাদের সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরো বহুদিন, বহু বছর। এ সংগ্রামে জয়ী হতে হলে এখন প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে জাতির উন্নয়নের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে। এখন আর আমাদের কোনো ঔপনিবেশিক প্রভু দেশ নেই। এখনকার পুঁজি লুটেরারা এ দেশের ক্ষমতাসীন মহল, দুর্নীতিবাজ আমলা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্রক্ষমতাকে অপব্যবহার করে এ লুটেরারা অবৈধ ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে ৪৬ বছর ধরে। পলাতক পুঁজি (capital flight) সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) জানাচ্ছে যে, এখন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৯ বিলিয়ন মানে ৯০০ কোটি ডলারেরও বেশি পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা, গার্মেন্ট মালিকরা, রাজনীতিকরা, দুর্নীতিবাজ আমলা ও প্রকৌশলীরা, ব্যাংকের রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপিরা বেধড়ক লুণ্ঠনের মাধ্যমে অবৈধ ধনসম্পদ আহরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে পুঁজি পাচার করে চলেছে। এরাই কানাডার টরন্টোতে বেগমপাড়া বানাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিনছে, ছেলেমেয়েদের বিদেশে অভিবাসী করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এভাবে যদি পুঁজি পাচার না হতো, তাহলে এরই মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। তাই জাতিকে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতেই হবে। এ মুক্তিযুদ্ধ হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের যুদ্ধ।

 

ড. মইনুল ইসলাম, ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বণিকবার্তার সৌজন্যে।