২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল অবলোপনসহ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দেন আবদুস সালাম। এরপর টানা তিন বছরের দায়িত্ব পালন শেষ করেন গত ২৮ অক্টোবর। বিদায় নেয়ার আগে ব্যাংকটিতে তিনি খেলাপি ঋণ রেখে গেছেন অবলোপনসহ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাত্ আবদুস সালামের তিন বছরেই জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
আবদুস সালামের এ তিন বছরে কমেছে ব্যাংকটির মুনাফাও। একইভাবে কমেছে ইকুইটির বিপরীতে আয় (আরওই) ও সম্পদের বিপরীতে আয়ও (আরওএ)। এ ব্যাংকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণে ছিল জনতা ব্যাংক। দায়িত্ব ছাড়ার সময় প্রভিশন ঘাটতির কিনারে রেখে গেছেন ব্যাংকটিকে। যদিও দায়িত্ব পালনকালে সবসময় নিজেকে সফল এমডি হিসেবে দাবি করেছেন আবদুস সালাম। এ বিষয়ে জানতে গতকাল তার সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারিতে ২০১৩ ও ২০১৪ সালজুড়ে টালমাটাল ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। ওই পরিস্থিতিতেই জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর যোগদান করেন আবদুস সালাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২৬ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর বাইরে অবলোপন করা হয় আরো ৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকার ঋণ। সব মিলিয়ে আবদুস সালাম এমডি হিসেবে যোগ দেয়ার প্রাক্কালে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এ ব্যাংকারের বিদায় নেয়ার আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঋণসহ জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ অবলোপন ছাড়াই। অর্থাত্ অবলোপন ছাড়াই আবদুস সালামের সময়ে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। তার সময়ে নতুন করে অবলোপনকৃত ৯৬৭ কোটি টাকা যোগ করলে বিদায়ী এমডির তিন বছর মেয়াদেই ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আবদুস সালামের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ২৯ অক্টোবর থেকে জনতা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমডি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। ব্যাংকটির পরবর্তী এমডি হিসেবে তার নিয়োগও মোটামুটি নিশ্চিত। আজ নিয়োগের চিঠি দেয়া হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। যোগাযোগ করা হলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই খেলাপি ঋণ আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখার ব্যবস্থাপকদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও পেয়েছি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। তবে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণও বেড়েছে জনতা ব্যাংকের। সাবেক এমডি আবদুস সালাম দায়িত্ব গ্রহণের সময় ব্যাংকটির প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি ২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা সংরক্ষণ করেছিল। এ হিসাবে আবদুস সালাম যোগদানের সময় জনতা ব্যাংক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছিল। কিন্তু দায়িত্ব ছাড়ার সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে প্রভিশন ঘাটতির কিনারে রেখে গেছেন তিনি।
আবদুস সালামের তিন বছরের মেয়াদকালে মুনাফাও কমেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির। তার যোগদানের আগের বছর ২০১৩ সালেও ৯৫৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল জনতা ব্যাংক। আর যোগদানের বছর ২০১৪ সালে ব্যাংকটি মুনাফা করে ৩৮১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে জনতা ব্যাংক ৪৮০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করতে সক্ষম হলেও গত বছর তা নেমে আসে ২৬০ কোটি টাকায়।
মুনাফায় বিপর্যয়ের এ ধারা চলতি বছরও অব্যাহত আছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৪৯৭ কোটি টাকা। তবে নতুন করে খেলাপি হয়ে যাওয়া বড় অংকের ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও কর পরিশোধের পর নিট লোকসানে পড়বে ব্যাংকটি। সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের লোকসানি শাখা দাঁড়িয়েছে ৮২টিতে। একই সময়ে ১ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হয়েছে।
এমডি হিসেবে আবদুস সালামের যোগদানের আগে ২০১৩ সালে জনতা ব্যাংকের ইকুইটির বিপরীতে আয় (আরওই) ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। ২০১৬ সালে তা ৫ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে সম্পদের বিপরীতে আয়ও (আরওএ) শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে ব্যাংকটির। ২০১৩ সালে জনতা ব্যাংকের আরওএ ছিল ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। বণিকবার্তার সৌজন্যে।