Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

immigration-museumবিশ্বব্যাপী মানুষের দেশত্যাগের হাজারো কারণ তালিকাবদ্ধ করার অবকাশ আছে। কিন্তু কোন দেশে সবচেয়ে বেশী অভিবাসী পাড়ি জমিয়েছেন সে প্রশ্ন করলে উত্তরটা দেয়া খুবই সহজ। সেই দেশটি অস্ট্রেলিয়া।

সরকারি নথি বলছে, কেবল ভিক্টোরিয়া স্টেটকে দু’শ দেশের মানুষ তাদের জীবনের ডেসটিনেশন বানিয়েছে। এরা ২৬০টি ভাষায় কথা বলেন। ১৩৫টি ধর্মে বিশ্বাসী তারা।

chardike-ad

১৭৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৯০ লাখের বেশী মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। আরো অগুণিত মানুষ সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং কোন না কোন কারণে ব্যর্থ হয়েছেন। ১৮শ’ সাল থেকে অভিবাসীদের নানান নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

এসব নিয়মকানুন আরোপ করেছে দখলবাজ ব্রিটিশরা। এখন যারা ‘অজি’ বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। তারা দাবি করে, ক্যপ্টেন কুক নামের ব্রিটিশ নাবিক অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেন। কিন্তু তার অনেক অনেক আগে থেকে সেখানে মানুষের বসতি ছিল। এখন যাদের সম্মান করে ‘প্রথম মানব’ বা ‘এবোরজিনাল’ বলা হয়।

১৮৩৪ সালে ভিক্টোরিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে ব্রিটিশ হেনটি পরিবার। ১৮৩৫ সালে জন ব্যাটম্যান এবং জন পাসকো ফকনার সমতল ভূমি ধরে অগ্রসর হতে শুরু করেন এবং ইয়ারা নদীর পাড়ের জমি দখল করেন। জন ব্যাটম্যান এবোরজিনাল নেতাদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেন যার মাধ্যমে দুই লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি দখল করে নেন। এসব জমিতেই সরকারি সব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৮৩৭ সালে ওই ভূখণ্ডের নামকরণ হয় ‘মেলবোর্ন’। ১৮৩৯ সালে প্রথম জাহাজভর্তি অভিবাসী আসে ব্রিটেন থেকে।

১৮৪০ এর দশক থেকে ভিক্টোরিয়া থেকে তুলা রপ্তানি শুরু হয়। ওই দশকে তুলা রপ্তানি করে ৫০ লাখ পাউন্ড আয় হয়। সেসময় ব্রিটেনে এতিম মেয়েদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর আইন পাশ করা হয়। অভিযুক্ত আসামীদের অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসনেও পাঠায় ব্রিটেন। ১৮৫২ সাল থেকে অবশ্য ব্রিটেন দাগী আসামীদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো বন্ধ করে।

সেসময়ে এবোরজিনালদের উপর অজিদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। ব্রিটিশদের সেই অত্যাচার ছিলো ভিন্ন মাত্রার। প্রাচীন মানবদের পরিবারে শিশু জন্মালে অজিরা সেই শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে যেতো। ওই শিশুদের ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে বড় করা হতো। কিন্তু বড় হয়ে ওই শিশুরা সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্নতায় ভুগতো। তারা অনেক সময় পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পালিয়ে যেতো। কিন্তু পরিবারের সঙ্গেও তারা স্বস্তি পেতো না। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তো এসব শিশু।

১৮৫১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় স্বর্ণের খণি আবিষ্কার হয়। যার আকর্ষণে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেখানে পাড়ি জমান। বাসস্থানের অভাবে ইয়ারা নদীর পাড়েই তারা অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করতে বাধ্য হন। এ সময়েই জার্মানি থেকে অভিবাসী আসতে শুরু করে। মেলবোর্নের বাইরের গ্রামগুলোতে তারা বসতি গড়ে তোলে। এর পর অভিবাসী আসে চীন, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আমেরিকা থেকে। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আসলেও অভিবাসীদের অনুমোদন দিতো ব্রিটিশরা।

১৮৬০ এর দশকে এসে অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন মানবদের প্রতি অজিরা নমনীয় হতে শুরু করে। ১৮৬৯ সালে এসে তাদের অধিকার স্বীকার করে ভিক্টোরিয়ান পার্লামেন্ট আইন পাশ করে। ১৮৭০ এর দশকে মেলবোর্নে শিল্পায়ন বাড়তে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে ১৮৭৩ সালে চীনা খনি শ্রমিকদের বিদ্রোহের ফলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। অর্থনীতি আবার চুপসে যেতে শুরু করে।

এই দশকেই এবোরজিনালদের অধিকার সুরক্ষায় এসোসিয়েশন গঠন করা হয়। পরের দশকে ১৮৮৮ সালে ‘হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া পলিসি’ অজিদের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। এ সময় পর্যন্ত চীনাদের অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে কমনওয়েলথভুক্ত করা হয়। চরম মন্দা অস্ট্রেলিয়াকে গ্রাস করে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।

১৯২২ সালে আবার ব্রিটিশদের সহায়তায় সীমিত আকারে অভিবাসন শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে ১৫ হাজার ইহুদী অভিবাসী নিতে রাজি হয় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে হতে মাত্র ৭ হাজার ৫০০ জন সেখানে যেতে সক্ষম হন।

১৯৪৯ সালে ‘কমনওয়েলথ ন্যাশনালিটি এন্ড সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট’ কার্যকর হয়। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশদের নাক গলানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে অস্ট্রেলিয়া ইউরোপের ২০টি দেশের সঙ্গে অভিবাসন চুক্তি সই করে। ১৯৬০ এর দশকে এসে এশিয়া থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাতে শুরু করেন।

১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট অস্ট্রেলিয়ার ভূমিতে এবোরজিনালদের অধিকার প্রথম বলে ঘোষণা করে। ২০০০ সালের মে মাসে দু’ লাখ ৫০ হাজার মানুষ সিডনি হার্বার ব্রিজে পদযাত্রা করে সেখানকার প্রথম পুরুষদের আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্যরি’ বলেন। এর আগের দুই শতকে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের উপর করা অত্যাচার-নির্যাতনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

কোথা থেকে এসেছি? “বংশানুক্রমে আমি সুদানী, জন্মসূত্রে ইথিওপিয়ান, বড় হয়েছি কেনিয়াতে, এখন আমি অস্ট্রেলিয়ান। আশেপাশের আরো অনেক তরুণের মতো আমিও নিজের জীবনের এবং প্রতিবেশের অর্থ তৈরী করার চেষ্টা করছি। ‘আমরা’ কে, তা নির্ধারণ করতে পারলেও অনেক সময় ‘আমি’ কে তা বুঝতে সুবিধা হয়।” এখনও অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তবে ইংরেজি ভাষা জানা দক্ষ মানুষদের সেখানে স্বাগত জানানো হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জন্মভূমি ছেড়ে মানুষ পরবাসী হয় কেন? নতুন দেশে পাড়ি জমানোর পর তাদের কী কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়? নতুন পরিবেশে তারা কীভাবে মানিয়ে নেন?

এ প্রশ্নগুলোর জবাব পেতেই মেলবোর্নে ‘ইমিগ্রেশন মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। অভিবাসীদের মুখোমুখি হয় মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। শুনতে চাওয়া হয় তাদের অভিজ্ঞতা। এসব অভিজ্ঞতা কখনো খুব কষ্টের, কখনো খুব মজার। কিন্তু প্রতিটি অভিজ্ঞতাই মনে দাগ কেটে যায়।

সপ্তদশ শতকে মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় আসতো সমুদ্রপথে, জাহাজ বা নৌকায় করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে পথ পরিবর্তন হয়েছে। জাহাজের স্থান দখল করেছে উড়োজাহাজ। কম সময়সাপেক্ষ এ জার্নি মানুষের জন্য আরামদায়কও বটে। এই জার্নিটাই অভিবাসীদের মনে থাকে।

মেলবোর্নের পুরনো কাস্টমস হাউসকে সুন্দরভাবে মেরামত করে ১৯৯৮ সালে ইমিগ্রেশন মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মিউজিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে এখন অভিবাসী মানুষের গল্প চোখে পড়ে।

দুইটা ফ্লোরজুড়ে মিউজিয়ামের গ্যালারি সাজানো। এছাড়াও বছরজুড়ে মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কমিউনিটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসব উৎসবে ওই কমিউনিটির খাবার, শিল্প-সংস্কৃতি অন্যদের মাঝে পরিচিতি পায়। কমিউনিটিগুলো সম্পর্কে গবেষণার সুযোগ করে দেয় এই মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ।

ইমিগ্রেশন মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য কমিউনিটিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন। তাই প্রতিটি কমিউটির জন্য এই মিউজিয়ামের দ্বার উন্মুক্ত। কমিউনিটিগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করে দেয় এই মিউজিয়াম যাতে তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরী হয়।

লেখক: ফাহমিদা আখতার, সৌজন্যে: চ্যানেল আই অনলাইন