পুঁজি ভেঙ্গে খাচ্ছে বিমানের ম্যানেজমেন্ট। প্রতি মাসে চার বার করে সভায় বসে মুখরোচক খাবার খাচ্ছে বছর দুই আগে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ। খেয়ে খেয়ে ৫৭০ কোটি টাকা লাভে থাকা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসকে তারা পরিণত করেছে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। এয়ারপোর্ট ও কর্মী ব্যবস্থাপনা, এয়ারক্র্যাফটের টেকনিক্যাল ত্রুটি, যাত্রীসেবা কোনোদিকেই তাই নজর নেই তাদের।
তাই কখনো আস্ত চাকা খুলে পড়ছে আধুনিক এয়ারক্র্যাফটের। কখনোবা আকাশে ওড়ার পর চাকা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কখনো চাকার পিন না খুলেই উড়াল দিচ্ছেন পাইলট। কখনো গ্রাউন্ড সাপোর্ট শাখার গাড়ির আঘাতে চুরমার হচ্ছে প্লেনের ইঞ্জিন। কাণ্ডজ্ঞানহীন পাইলটরা যাত্রীবোঝাই প্লেন রেখে কেনাকাটা সারছেন ডিউটি ফ্রি শপে। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উড্ডয়নকালে অত্যাধুনিক এয়ারক্র্যাফটের ওয়েল ট্যাংকারের নাট ঢিলা হয়ে পড়ার মতো বিস্ময়কর কাণ্ডও ঘটছে।
বিমান কর্মীদের গাফিলতির কারণে এভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ছাড়াও ফেঁসে যাচ্ছে ফ্লাইট শিডিউল। এয়ারপোর্ট ও ইনফ্লাইট সেবার মান পড়ে যাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন যাত্রীরা। কিন্তু এসব ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন থাকছেন কর্তারা। বিমানের ম্যানেজমেন্টকে তাই অথর্ব বলছেন বিভিন্ন এয়ারল্যাইন্স সংশ্লিষ্টরাই।
সংশ্লিষ্ট পরিমণ্ডলে চাউর আছে, রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কার্যত ইউনিয়নের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখানে চেয়ারম্যান ও বোর্ডের কোনো ভূমিকা নাই। তাই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও লোকদেখানো তদন্ত কমিটি করে দায় সারছে ম্যানেজমেন্ট। ওসব তদন্ত কমিটির কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না পরে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টাস্কফোর্সের এক রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ৩২ বার দুর্ঘটনায় পড়েছিলো বিমানের প্লেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্ট গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব তদন্ত রিপোর্ট সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণই করেনি ফ্লাইট সেফটি বিভাগ।
এমনকি এসব দুর্ঘটনার দায় প্রথমত প্রকৌশল বিভাগের ওপর বর্তালেও তাদের যেনো সাত চড়েও রা নেই। তাদের দিকে নজরও নেই কারো। তাই ৭ মাস ধরে প্রকৌশল শাখার পরিচালকের পদ শূন্য থাকলেও তা পূরণ করতে সমর্থ হয়নি বিমান।
এসব কারণে দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক রুটেও চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে বিমান। কমে যাচ্ছে যাত্রী। আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে এখন প্রায় সব ফ্লাইটেরই অধিকাংশ আসন শূন্য থাকছে।
চলতি মাসেই পরপর দুটি দুর্ঘটনায় শত কোটি টাকা ক্ষতি হলেও বিমানের পরিচালনা পর্যদ ও ম্যানেজমেন্ট কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এর আগে গত অক্টোবরে গ্রাউন্ড সাপোর্ট শাখার বেল্টারের (গাড়ি) আঘাতে বিমানের একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রকৌশল শাখার মেরামত করা গাড়ির আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় অপর একটি প্লেন। গত নভেম্বরে অয়েলের ট্যাংকের নাট ঢিলা হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হাঙ্গেরিগামী বোয়িংকে জরুরি অবতরণ করতে হয় তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাত এয়ারপোর্টে। ডিসেম্বরে মাসকট থেকে উড্ডয়নের পর প্লেনের চাকা ফেটে গেলে চরম ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট অবতরণ করতে হয় শাহজালালে। তারপর ঘটে চাকার পিন না খুলেই আকাশে উড়ে ফের জরুরি অবতরণের অবাক করা কাণ্ড। গত জুনে ব্যাংককগামী এক ফ্লাইটের পাইলট চাকার পিন না খুলেই আকাশে উড়ে জরুরি অবতরণে বাধ্য হন। জুলাইয়ে একজন অপারেটরের গাড়ির আঘাতে একটি ৭৭৭ এয়ারক্র্যাফট অচল হয়ে পড়ে।
থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে ককপিটের দরজা লাগিয়ে যাত্রীবোঝাই ফ্লাইট ফেলে ব্যক্তিগত কেনাকাটা করতে ডিউটি ফ্রি শপে যান দুই পাইলট।
উড্ডয়নের পরপরই প্লেনের চাকা খুলে ছিটকে পড়ে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশের ধানক্ষেতে। বরাবরের মতো এবারো দায়সারা তদন্ত কমিটি গড়েছে ম্যানেজমেন্ট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হওয়ার পর গত দুই বছরে বিমানে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দুবছর আগে বিমানের নতুন উড়োজাহাজ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিমান ৫৭০ কোটি টাকা লাভ করেছে। বিমানের বহরে যোগ হয়েছে ৬টি নতুন উড়োজাহাজ। অর্থাৎ মরা গাছে সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবুজ পাতা ঝরে গাছটিও এখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। বিমানকে বাঁচাতে তাই দ্রুত নতুন সিইও নিয়োগ ও পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবার অভিযোগ, সব অনিয়ম, আবহেলা আর স্বেচ্ছাচারিতার ঘটনা আড়াল করে বিমানকে পথে বসাচ্ছে ম্যানেজমেন্ট। প্রকৌশল ছাড়াও এখন কাস্টমার সার্ভিস, স্টোর ও পরিকল্পনাসহ ৫টি বিভাগ পরিচালক ছাড়াই চালাচ্ছে তারা। সৌজন্যে: বাংলানিউজ