ষাটের দশকে কোরিয়ান কংগ্লোমারেট কোম্পানীগুলোর যাত্রা শুরু হয়। কোরিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে অনেক কোম্পানী সারাবিশ্বে রাজত্ব করছে। স্যামসাং, হুন্দাই, এসকে, এলজি, পোসকোসহ অনেক কোম্পানী এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে ব্যবসা করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে এইসব কোম্পানীর বিশাল একটা অবদান আছে। এইসব কনগ্লোমারেট কোম্পানীগুলোর মধ্যে কিছু একই রকম সংস্কৃতি আছে, আবার কোম্পানীভিত্তিক আলাদা আলাদা কিছু সংস্কৃতি আছে। সিনসেগে গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শিনসেগে ইন্টারন্যাশনালে চার বছর দশ মাসের কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংস্কৃতির কিছু অংশ তুলে ধরছি।
কোরিয়ানদের সময়জ্ঞান
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম চাকরি শুরুর কয়েকদিন পরের ঘটনা। একদিন দেরীতে ঘুম ভাঙ্গায় তাড়াহুড়া করে ট্যাক্সি নিয়ে অফিসে গিয়েও ১ মিনিট দেরী করলাম। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে প্রবেশের নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ সহকর্মী ৮টার মধ্যেই উপস্থিত থাকেন। সেদিন আমি ৮টা ৩১ মিনিটে প্রবেশ করেছিলাম। আমার টিম লিডার আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রায় ২০ মিনিট ‘কোরিয়ান অফিস টাইম’ বিষয়ক জ্ঞান দিলেন। এই কোম্পানীতে চারবছর ১০ মাসের চাকরি জীবনে আর মাত্র একদিন ৩ মিনিট দেরী করেছিলাম। সেদিন বাসা থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময়ই মেসেজ করে জানিয়ে রেখেছিলাম যে আমার ৫/১০মিনিট দেরী হবে।
কোরিয়ান কোম্পানীগুলোর সাধারণ নিয়ম হলো নির্ধারিত সময়ের কমপক্ষে ২০/৩০মিনিট আগে উপস্থিত থাকা। কাজ শেষে অফিস থেকে যাওয়ার সময় দেখে নিতে হবে বস আছে কিনা। বস অফিসে থাকলে আগে বের হয়ে যাওয়াটা কোরিয়ান রীতিতে নেই।
ইমেইল, ফোন আর মিটিং
সকালে সারাদিনের কাজ নোট করার পর ইমেইল চেক করার মধ্য দিয়ে শুরু দিনের কর্মজীবন। এরপর সারাদিন ইমেইল চেক করা এবং উত্তর দেওয়া অন্যতম প্রধান কাজ।কোরিয়ান কোম্পানী আইন অনুযায়ী, ইমেইলকে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। যেকারণে বেশিরভাগ কোম্পানীর সাথে কাজকর্ম হয় ইমেইলে। কোন কনফার্মেশন ফোন বা মৌখিকভাবে দিলেও ইমেইলে তা পুনরায় কনফার্ম করা হতো। কন্ট্রাক্টগুলোও ইমেইলেই আদান প্রদান হয়। সারাদিন ফোন রিসিভ করা এবং নিজের কাজের প্রয়োজনে ফোন দেওয়া কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলোর সাথে বিভিন্ন কাজে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সারাদিন ২০ থেকে ৪০ বার ফোন দিতে হতো। তবে কোম্পানীর মধ্যে সহকর্মীদের সাথে চ্যাটরুমের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।
কোম্পানীভেদে ভিন্নতা থাকলেও সপ্তাহে কমপক্ষে একটা টিম মিটিং হবেই। ছোট ছোট মিটিংতো প্রায় প্রতিদিনই থাকে। মিটিং হলো কোরিয়ান কোম্পানীগুলোর প্রাণ। আমার ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিন সকাল নয়টায় ১০/১৫ মিনিটের জন্য একটা মিটিং দিয়ে দিন শুরু হতো। সারাদিন গড়ে ৪/৫টা মিটিং থাকতো যেসব কোম্পানীর সাথে কাজ করি তাদের সাথে। টিমের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা দেখা দিলে টিম মিটিং এ সমাধান করা হতো।
টিমভিত্তিক কাজ ও বসকে অনুসরণ করা
উর্ধ্বতন কেউ যেকোন কাজ দিলে অন্যসব কাজ ফেলে ঐ কাজেই মনোযোগ দিতে হবে। ৫/১০ মিনিট যেতে না যেতে বস আপডেট জানতে চাইতে পারেন। এই সংস্কৃতি কোরিয়ান কোম্পানীগুলোর মধ্যে মারাত্মকভাবে বিদ্যমান। কোরিয়ানরা বলে থাকে শুধু বসের কথা অনুসরণ করলেই সারাজীবন সুন্দরভাবে চাকরিজীবন পার করা যায়।
কোরিয়ানরা প্রচন্ড উচ্চবিলাসী। নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা কাজ করে। কাজে নতুনত্ব নিয়ে আসা, ব্যবসায় গতি আনা, নতুন প্রোডাক্ট কিংবা ব্যয় কমানোসহ নানা ধরণের প্রজেক্ট নেয় টিমের মেম্বাররা। দৈনন্দিন কাজের পাশপাশি এই ধরণের স্কিল দিয়েই প্রমোশন পেতে হয়। ব্যক্তিগত এবং টিমের আলাদা আলাদা পারফর্মেন্স বিচার করেই প্রমোশন হয়ে থাকে। ফলে দুইদিকেই ভাল ফলাফলের দিকে জোর দিতে হয়।
হোয়েশিক
কোরিয়াতে ‘হোয়েশিক’ নামে ডিনার পার্টির প্রচলন আছে। প্রত্যেক মাসে টিমভিত্তিক এই ডিনার পার্টি হয়ে থাকে। কোম্পানীভেদে মাসে দুইবারও হয়ে থাকে। মদ থাকে এই পার্টির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কোরিয়ানরা মনে করে এই ‘হোয়েশিক’ এর মাধ্যমেই নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে। একজনের প্রতি আরেকজনের ক্ষোভ থাকলে তা নিরসন করা যায়। হোয়েশিক পার্টিতে সবাইকে মন খুলে কথা বলতে দেখা যায়। হোয়েশিকের পর দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে অনেকেই গান গাইতে ‘নোরেবাং’ নামের কারাওকে’তেও যায়।
প্রশিক্ষণ
কোম্পানীর কর্মীদের দক্ষ করার জন্য প্রচুর ব্যয় করে কোরিয়ান কোম্পানীগুলো। ট্রেনিং, ক্লাস, অনলাইন ক্লাস কিংবা সেমিনারে অংশ নেওয়া কোম্পানীগুলোতে নিয়মিত ঘটনা। প্রায় প্রতিমাসেই বিভিন্ন ধরণের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কোর্স, ক্লাস ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। প্রতিবছর এক বা দুইবার নিরাপত্তা বিষয়ক, তথ্য আদানপ্রদানে বাধ্যবাধকতা, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাধ্যতামূলক অনলাইন কোর্স করতে হয়।
তথ্যের শেয়ারিং
কোরিয়ান কোম্পানীগুলোর সাফল্যের অন্যতম মাধ্যম মনে হয়েছে তথ্যের শেয়ারিং। আমার তত্ত্বাবধানে যে প্রোডাক্ট মার্কেটে যাচ্ছে কিংবা আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেসব ব্যবসার সাথে জড়িত তার অবস্থা সবসময় দেখা যায়। সাপ্তাহিক, মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক সব রিপোর্ট দেখা যায়। ফলে কোম্পানী কত টাকা আয় করছে, লাভে আছে না লসে আছে তা খুব সহজেই জানা যায়। এতে কর্মীদের কাছে কোম্পানীর অবস্থান পরিস্কার থাকে। ফলে কোম্পানীর দূরাবস্থায় কর্মীরা সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।
স্বেচ্ছাশ্রম এবং অনুদান
প্রায় সব কর্পোরেট কোম্পানী থেকে মাসে একবার বা দুইমাসে একবার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শ্রম দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম, অনাথ কিংবা নিন্ম আয়ের শিশুদের স্কুলে গিয়ে তাদের সাথে সময় কাটানো, বাগান পরিস্কার করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শ্রম দিতে হয়। প্রত্যেক কর্মীর বেতন থেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের অর্থ কেটে রাখা হয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেওয়ার জন্য।
এছাড়া কোরিয়াতে পিয়ন কিংবা বয় বলতে কিছু নেই। কফি/চা নিজে তৈরী করে নিজে খেতে হয়। ফটোকপি, স্ক্যান কিংবা প্রিন্ট নিজেরগুলো নিজের করে নিতে হয়।
সরওয়ার কামাল, সম্পাদক, বাংলা টেলিগ্রাফ।