মানুষ জন্মগতভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে মহৎ গুণ, ন্যায়বিচার ও সৌন্দর্যের অনুরাগী এবং সব ধরনের নোংরা বা মন্দ বিষয়কে ঘৃণা করে। ইসলামও একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে সব ধরনের উন্নত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটানো এবং সব ধরনের মন্দকে প্রতিরোধের জন্য নানা বিধি-বিধান দিয়েছে। তাই এ ধর্ম মানব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে মানব-প্রকৃতির সঙ্গে এ ধর্মের সঙ্গতিসহ নানা গুণ ও মূল্যবোধ প্রতিপালনকারী এই মহান ধর্মের পরিপূর্ণতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে মুগ্ধ হচ্ছেন অনেক অমুসলিম এবং তারা গ্রহণ করছেন এই অকৃত্রিম ধর্ম। ব্রিটিশ নও-মুসলিম মিসেস ‘নাতাশা’ হচ্ছেন এমনই এক সৌভাগ্যবানদের একজন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
“১২ বছর বয়স থেকেই আত্মিক ও ধর্মীয় বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতাম। আমার ধর্ম বিশ্বাস ছিল কেবল এটাই যে আমি আল্লাহ বা স্রস্টার প্রতি বিশ্বাসী ও ঈসা মাসিহ মানবজাতির ত্রাণকর্তা। যতই বড় হচ্ছিলাম ততই এসব বিষয়ে বেশি পড়াশোনা করছিলাম। বিভিন্ন উৎস থেকে পড়াশোনা করতে গিয়ে একবার এটা জানতে পারি যে, ঈসা (আ.) খোদা নন, বরং আল্লাহর একজন নবী এবং তারপরেও একজন নবী এসেছেন এবং সেই নবী আসার সুসংবাদ খোদ ঈসাই দিয়ে গেছেন। তাই ঈসার পর যে নবী এসেছেন সে বিষয়ে গবেষণা করতে উদ্যোগী হলাম। আর এই গবেষণাই আমাকে মুসলমানে পরিণত করেছে।”
তরুণ মুহাম্মাদ (সা.)’র সঙ্গে একজন খ্রিস্টান পাদ্রির সাক্ষাতের ঘটনাও দৃষ্টি আকৃষ্ট করে নাতাশার। ইতিহাসে এসেছে, তরুণ বয়সে মুহাম্মাদ(সা.) তাঁর চাচা আবু তালিব (রা.)’র সঙ্গে সিরিয়ার দিকে গিয়েছিলেন। তাঁরা এক জায়গায় বিশ্রামের জন্য থেমেছিলেন। সেই এলাকায় থাকতেন ‘বাহিরা’ নামের এক পাদ্রি। এই পাদ্রির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে। বাহিরা ছিলেন খাঁটি খ্রিস্টান ও জ্ঞানী। বাহিরা কুরাইশ কাফেলায় বিশ্বনবী (সা.)’র নুরানি ও ভাবুক প্রকৃতির চেহারা দেখে তাঁর দিকে যান ও কয়েকটি প্রশ্ন করার পর তাঁর কাঁধগুলো দেখানোর অনুরোধ করেন।
বিশ্বনবী (সা.)’র কাঁধের মধ্যে বিশেষ চিহ্নের ওপর নজর পড়তেই তিনি বেশ আবেগ বা উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠলেন: হ্যাঁ, এটাই তো সেই চিহ্ন যার বর্ণনা আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে নিখুঁতভাবে এসেছে। এরপর বাহিরা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন আবু তালিব (রা.)-কে: এই তরুণ কে? আবু তালিব বললেন, আমার সন্তান। বাহিরা বললেন: না, না, এই যুবকের পিতা তো বেঁচে থাকার কথা নয়! আবু তালিব অবিশ্বাস্য সুরে বললেন: আপনি কিভাবে জানলেন? হ্যাঁ, সে আমার ভাতিজা। তাঁর পিতা তাঁর জন্মের আগেই মারা গেছেন।
বাহিরা বললেন: “এই শিশুর ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। ইনি হচ্ছেন সেই নবী যাঁর নাম ও যাঁর বাবার এবং দাদার নাম ধর্মীয় বই-পুস্তকে পড়েছি। ইনিই হলেন প্রতিশ্রুত শেষ নবী। এই নবী আসারই সুসংবাদ দিয়ে গেছেন ঈসা (আ.)।”
এই কাহিনী নাতাশাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এরপর তিনি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে জানার জন্য আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিশ্বনবী (সা.)’র অনুপম চরিত্র ও গুণাবলীও নাতাশাকে ইসলামের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।
নাতাশার কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে মহানবী (সা.)’র ব্যক্তিত্ব এত বেশি রহমত ও দয়ায় পরিপূর্ণ যে এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁকে “বিশ্ববাসীর জন্য রহমত” বলে উল্লেখ করেছেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দয়ার ক্ষেত্রে তিনি সব মহামানবকে ছাড়িয়ে গেছেন। বিশ্বনবী (সা.) সব সময় মুসলমানদেরকে পরস্পরের সঙ্গে ও এমনকি অমুসলমানদের সাথেও আচার-আচরণে দয়ার্দ্র এবং নমনীয় হতে পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে বিশ্বনবী (সা.)’র দয়ার্দ্র ও বিনম্র আচরণই ইসলামের প্রতি অমুসলমানদের আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বনবী (সা.) যুক্তি ও সংলাপের ভিত্তিতে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতেন। এভাবেই তিনি মানুষের পবিত্র প্রকৃতি বা বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতেন। এমনকি মহানবী (সা.) অন্যান্য ঐশী ধর্মের অনুসারীদেরকে বলেছেন: আসুন আমরা অভিন্ন এক বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছি। আর এই অভিন্ন বিষয়টি হল, এক আল্লাহর ইবাদত যা মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সহমর্মিতা সৃষ্টি করে।
আর এইসব বাস্তবতা ইসলামের প্রতি নাতাশার আগ্রহকে ক্রমেই বাড়িয়ে তোলে এবং তিনি ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা ও পড়াশোনার পাশাপাশি মুসলিম সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:
“ঘটনাক্রমে ওই সময়টা ছিল পবিত্র রমজান মাস। এ সময় মুসলমানরা ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করে মন ও আত্মাকে পবিত্র করেন। আর আমিও একজন মুসলিম বন্ধুর আমন্ত্রণে তার আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যোগ দেই। এই মাহফিল ছিল পবিত্রতার এক বিশেষ আনন্দে ভরপুর। প্রথমে উপস্থিত মুসলমানরা সবাই একসাথে নামাজে দাঁড়ালেন। নামাজের পর সবাই একসঙ্গে উৎফুল্ল চিত্তে ইফতারির দস্তরখানের পাশে বসলেন। কত যে পবিত্র-আনন্দ ও আন্তরিকতার বন্যা ছড়িয়ে পড়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। দস্তরখানে ইফতার-সামগ্রীও ছিল সাদামাটা এবং সেসব বিশেষ ভঙ্গিতে সাজানো হয়েছিল। খোরমা, হালুয়া, চা ও সুপ ছিল ইফতারের কিছু আইটেম। মুসলমানরা এমন রহমতের মাস দান করার জন্য মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন ইফতারের সময় এবং এরপর নিজের ও অন্যান্য মুসলমানদের জন্য দোয়া করছিলেন।”
রমজানে মুসলমানদের পবিত্র অনুভূতি ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ নাতাশা আরো বলেছেন, ”সেই ইফতার মাহফিলে মুসলমানরা একে-অপরকে এমনভাবে সহায়তা করছিলেন যে মনে হচ্ছিল যেন কেউই মেজবান বা নিমন্ত্রণকারী নন। মনে হচ্ছিল যেন সবাই একই পরিবারের সদস্য। তারা সবাই আমার সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুর মতই আচরণ করছিলেন। ইফতারের পর সবাই পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হলেন। এরপর পরস্পরের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা ও নানা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আর আমিও আগ্রহ নিয়ে তাদের আলোচনা শুনছিলাম এবং কিছু প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ তুলে ধরছিলাম। ধীরে ধীরে অনুভব করছিলাম যে আমি যা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম সেইসব সত্যই আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। সেখানে আমি জানলাম যে, ইসলাম মানুষকে জীবন-যাপনের সঠিক পথ শেখায় এবং জীবনকে যোগায় খোদায়ী লক্ষ্য। বিশ্বনবী (সা.)’র মত আদর্শ আমাদেরকে তাঁরই মত সর্বোত্তম আচরণ করতে ও সৌভাগ্য অর্জনে উৎসাহ যোগায়।”
নওমুসলিম নাতাশার কাছে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বনবী (সা.)-কে আদর্শ হিসেবে মানেন বলেই মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণে তাঁর প্রভাব রয়েছে। কারণ, মহানবী (সা.) আচার-আচরণ ও কথা-বার্তায় মুসলমানদেরকে দয়ার্দ্র হতে বলতেন। এরপর থেকে নাতাশা মুসলমানদের সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগ এবং মেলামেশা করতে থাকেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
“এরপর থেকে মুসলমানদের নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। কখনও নানা উৎসবে, কখনও জুমার নামাজে এবং ধর্মীয় বৈঠকে উপস্থিত হতাম। এভাবে আগের চেয়েও ইসলামের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তে লাগল। এমনকি ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণের জন্যও প্রস্তুত হচ্ছিলাম। অবশ্য এটাও অনুভব করছিলাম যে শয়তান এ পথে বাধা দেয়ার জন্য নানা কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। অবশেষে দয়াময় আল্লাহর ইচ্ছায় শয়তানের কুমন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৯৭ সালে পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। এভাবে আমি এমন এক জগতে প্রবেশ করি যেখানে যা-ই দেখতাম তাতে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু দেখতাম না।” সৌজন্য: পার্সটুডে