Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

bosu-recipeস্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখা এক বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর হামলা চালিয়ে চারিদিকে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন রাজবিহারী বসু। গুরুতর ঐ হামলার পর রাসবিহারীর কয়েকজন সঙ্গী গ্রেফতার হলেও অধরা থেকে যান তিনি। তলে তলে ব্রিটিশকে ভারত ছাড়া করার জন্য দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। ১৯১৬ সালে তার এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। সব কিছু মিলে দেশে টিকে থাকাটা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়লে রাসবিহারী বসু পাড়ি জমান জাপানে। সেখানে এশীয়-জাতীয়বাদী রাজনীতিবিদ তোওমা মিত্সুরুর বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।

পুলিশ জানতে পেরেও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আশ্রয়দাতার কন্যার সাথে প্রেম অতঃপর পরিণয়। সোওমা তোশিকোর সাথে নতুন জীবন শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই যক্ষ্মায় স্ত্রীকে হারান। এতো সব ঘটনাপ্রবাহ ছাপিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিখ্যাত হওয়ার রশদ খুঁজে নিলেন রাসবিহারী। স্ত্রীর বিয়োগের পর শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রস্তাব দিলেন তাদের রুটির বেকারিতে ভাত এবং মুরগির ঝোল বিক্রি করতে চান তিনি। আর এই মুরগির ঝোলই রাসবিহারীকে এনে দিয়েছে খ্যাতি।

chardike-ad
bosu-recipe
নাকামুরায়া চিকেন কারি রেসিপির নব্বই বছর পূর্তি উৎসবের পোষ্টার

নাকামুরায়া চিকেন কারি নামে জাপানিদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল রাসবিহারীর মুরগির ঝোল। জাপানের মুরগির ঝোল কিংবা ভারতীয় মুরগির ঝোলের থেকে নাকামুরায়া চিকেন কারির স্বাদ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। কড়া রং নেই, পাতলা ঝোলও থাকে না। বেশ ঘন। কিন্তু খুবই সুস্বাদু আর সুগন্ধী বলা যায় একেবারে খাঁটি বাঙালি মুরগির ঝোল।

এখনো জাপানের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নাকামুরায়া চিকেন কারির প্রসঙ্গ এলে রাসবিহারী বসুর কথা উঠে আসে। রাসবিহারী যে রেস্টুরেন্টে প্রথম এই মুরগির ঝোল তৈরি করা শুরু করেন সেটি এখন অন্যের মালিকানায়। রোস্তোরাঁর মালিকানা বদল হয়েছে, নতুন সাজে সেজেছে কিন্তু এখনো সেখানে রাখা আছে রাসবিহারী বসু আর তার পত্নীর ছবি। রয়েছে একটি পুরনো পোস্টার যেখানে লেখা রয়েছে -আমরা বাঙালি কারি পরিবেশন করি, যেটা জাপানে নিয়ে এসেছিলেন একজন ভারতীয় বিপ্লবী।

bosu-with-wife
রাসবিহারী বসু ও তাঁর স্ত্রী সোওমা তোশিকো

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাকামুরায়ার প্রধান শেফ নিনোওমিয়া তাকোশি এই মুরগির ঝোল পরিবেশন করে আসছেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, জাপানে কারির প্রচলন হয় ১৯১০ সাল নাগাদ। রাইসু কারি বা কারি রাইসু নামের সেই মুরগি ঝোল ভাত প্রথমে বড় রেস্তোরাঁ, তারপরে শহরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে মাংসের থেকে সবজিই বেশি থাকত। ঝোলটা গাঢ় করা হত ময়দা মিশিয়ে। ভাতের সঙ্গে খাওয়া হতো সেটা। এখনও প্রচলিত আছে সেই রেসিপি; কিন্তু রাসবিহারী বসুর পদ্ধতিতে আমরা যে কারি তৈরি করি, সেটা রাইসু কারি থেকে অনেকটাই আলাদা। রাসবিহারীর রেসিপি অনুযায়ী ঝোল গাঢ় করতে ময়দা মেশাতে হয় না। সবজি সেদ্ধ হতে হতেই ঝোল ঘন হয়ে যায়। হাল্কা স্বাদের এই কারিতে এমন সব মশলা মেশানো হয়, যেগুলোর ভেষজ গুণও রয়েছে, তাই নিয়মিত খেলেও স্বাস্থ্যহানির কোনো আশঙ্কা থাকে না।

bosu-recipe
প্রথমদিকে এভাবেই পরিবেশন করা হত নাকামুরায়া চিকেন কারি বা বাঙালী মুরগির ঝোল ভাত

রাসবিহারী বোস জাপানীদের স্বাদ বুঝে গিয়েছিলেন সেজন্যই তিনি তাদের পছন্দ হবে, এরকমই কারি তৈরি করেছিলেন। সেজন্যই এত বছর পরেও জাপানে অতি জনপ্রিয় এই নাকামুরায়া কারি। একদিকে দিনের পর দিন বাঙালি ঐ মুরগির ঝোল জাপানিদের কাছে জনপ্রিয় করে উঠতে থাকে। অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠিত করার কাজও চালিয়ে গেছেন সমান গতিতে। সুভাষ চন্দ্র যখন জাপানে পৌঁছলেন, সেই ফৌজের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাসবিহারী। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, যে একদিন ভারতের স্বাধীনতা দেখবেন, সেটা অবশ্য আর পূরণ হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগেই যক্ষ্মায় ভুগে মৃত্যু হয় তার। তবে ওই বাঙালি বিপ্লবীর তৈরি মুরগির ঝোল ভাত এখনো জাপানিদের হূদয়ে গেঁথে আছে – কিছুদিন আগেই যে রেসিপির নব্বই বছর পূর্তি উত্সব পালন করল নাকামুরায়া। সূত্র: বিবিসি বাংলা