সেনাচৌকিতে হামলার অজুহাতে আবারো শুরু হয়েছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করে বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে দেয়া। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি এবারো এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মাঠে নেমেছে বৌদ্ধ ভিুদের দ্বারা সন্ত্রাসী সংগঠন ‘নাইন সিক্স নাইন’। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মজলুম রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন মিডিয়া সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তারপরও দেশটির মূল সান সুচি বলে বেড়াচ্ছেন, ‘রাখাইনে সবাই নিরাপদে’। তার এই ভূমিকা প্রমাণ করে, তাদের দৃষ্টিতে ‘জীব হত্যা মহাপাপ; কিন্তু মুসলমান হত্যা মহালাভ’। প্রতিটি দেশ এই মহা-হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো সত্তেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মমতা অব্যাহত রয়েছে। তাই বলতে হচ্ছে, যত অত্যাচারিত হোক না কেন মুসলমানদের মানবাধিকার যেন থাকতে নেই।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক আচরণের সূত্র দীর্ঘ। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ যখন ছেড়ে যাচ্ছিল তখন তারা এমনভাবে বাটোয়ারা এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে যায় যে, এতদঞ্চলের সব নাগরিককে দীর্ঘ দিন খেসারত দিতে হচ্ছে। তেমন একটি সমস্যা হলো রাখাইন মুসলমান বা রোহিঙ্গা। উপমহাদেশ বিভাজনের সময় বার্মার ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবাইকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়া হলো না। অথচ অনেক জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ-সাত হাজার।
এভাবে অমানবিক বিভাজনের যাঁতাকলে পড়ে বার্মার মুসলমান আজ নিঃস্ব প্রায়। মিয়ানমারে মুসলিমরা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় ৪০ জনের মতো। তারপরও তারা আজ নিজ জন্মভূমিতেই প্রবাসী। কিন্তু কোথায় আজ জাতিসঙ্ঘ? কোথায় ওআইসি? কোথায় মানবতাবাদী সংগঠনগুলো? মুসলমানদের স্বঘোষিত মোড়ল মুরব্বি দেশগুলো নিশ্চুপ কেন? অপর দিকে এত রাষ্ট্র বা সরকার এই বর্বরোচিত নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন; এরপরও কেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সমাধান হচ্ছে না?
রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এই সঙ্কটের নেপথ্যে বহু কারণ আছে। গণমাধ্যম আরটিকে’র সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক শক্তির ক্রীড়নকেরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি উসকে দিচ্ছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের পেছনে অন্তত এসব কারণও ভূমিকা রাখছে বলে জানা যায়।
১) চীনা স্বার্থ নিয়ে একটি ‘খেলা’; কারণ আরাকানে (রাখাইন রাজ্যে) চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে;
২) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস।
৩) আসিয়ানের মধ্যে অনৈক্য (মিয়ানমার এবং মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অনৈক্য) তৈরি করার কারসাজি।
মোটকথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে এই সঙ্ঘাতকে ব্যবহার করছে ‘আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়’রা। বিশেষ করে, রাখাইন রাজ্যের উপকুলীয় এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল রিজার্ভের দিকে দৃষ্টি পড়েছে তাদের।
মিয়ানমারের সাবেক সেনাশাসক থান শুয়ের নামে কয়েকটি গ্যাসফিল্ড রয়েছে। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল জ্বালানি সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে বিশেষ করে চীনের দৃষ্টি পড়ে। ২০১৩ সালে তেল ও গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ করেছে দেশটি। এই পাইপলাইন রাখাইনের বন্দর কিয়াউকপিউ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং পর্যন্ত। এ সুযোগ চীন কখনো হারাতে চায় না। মিডিয়ার খবর পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, কোনো কোনো প্রভাবশালী দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য এমন অমানুষিক ও অমানবিক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে যা চিন্তা করতেও গা শিউরে ওঠে। বিশ্ববিবেক ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ হয়ে রাখাইনের গণহত্যার মর্মান্তিক দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে।
বৌদ্ধদের উক্তি, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’। কিন্তু তারা আচরণে দেখাচ্ছে ‘মুসলিম হত্যা মহাপুণ্য’। তাহলে মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই? এরপরও বিশ্ব মুসলিম আর কতকাল নীরব দর্শক হয়ে বিনা দোষে মার খাবে, নির্মূল হবে? উম্মাহর জন্য প্রয়োজন একজন মোহাম্মদ বিন কাসিমের মতো ঈমানদার বীর মুজাহিদ। তিনি হাজার হাজার মাইল দূরের আরব দেশে একটি কিশোরীর চিঠি পেয়ে তাকে রক্ষার জন্য ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন এবং অত্যাচারী রাজা দাহিরকে পরাস্ত করে সিন্ধু বিজয় করেছিলেন। অথচ আজ হাজারো রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরীর কান্নায়ও আমাদের ঘুম ভাঙছে না। অসহায় ও নির্যাতিত মুসলিমদের কান্নায় হৃদয় গলছে না বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতিক প্রমুখের।
লেখক: প্রিন্সিপাল বেলায়েত হোসাইন আল-ফিরোজী, জাতীয় ইমাম সমাজ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা