Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

trump-kim‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা’ ভিডিও গেমসেই বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া একই খেলায় মেতেছে সত্যিকারের অস্ত্র আর হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে। বিষয়টি খেলার মতোই দৈনন্দিন বিষয় হয়ে গেলেও আসল যুদ্ধও শুরু হতে পারে যে কোনও সময়! গত কয়েক বছর ধরে উত্তর কোরিয়া আরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলছে হুমকি আর পাল্টা হুমকি। হুমকি অনুযায়ী কাজ হলে বেশ আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতো। সেটা হয়নি। আবার শঙ্কাও কাটেনি!

পরিস্থিতি এখন চরমে। সর্বশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, উত্তর কোরিয়া ‘বেশি বাড়াবাড়ি’ করলে কার্যত তাদের ধ্বংস করে দেবে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘আমেরিকার ক্ষমতা প্রচুর। সেই সঙ্গে ধৈর্য্যও। কিন্তু নিজেকে বা নিজের মিত্র পক্ষকে যদি বাঁচাতে হয়, তা হলে আমাদের কাছে উত্তর কোরিয়াকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না’। কিমকে ‘রকেট ম্যান’ বলে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, ‘উনি তো আত্মহত্যার পথে হাঁটছেন’।

chardike-ad

বস্তুত কয়েক মাস ধরে একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জের মুখে রেখেছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। খুব সম্প্রতি শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা সেরে ফেলেছেন কিম। তার এক একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা যত ভারী হয়েছে, ততই সুর চড়েছে কিমের। উত্তর কোরিয়ায় বসে আমেরিকার বিভিন্ন শহরকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে গিয়েছেন তিনি। মাস কয়েক আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় মার্কিন দ্বীপ গুয়ামকে উড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন কিম। জবাব দিয়েছিলেন ট্রাম্পও। জানিয়েছিলেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারাও।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানকে সঙ্গে নিয়ে কোরীয় উপদ্বীপে বোমাবর্ষণ করেছে মার্কিন বাহিনী। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের বিমান বহরকে সঙ্গে নিয়ে এদিন কোরীয় উপদ্বীপের আকাশে উড়ে মার্কিন স্টেল্‌থ ফাইটার এবং বোমারু বিমান। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের খুব কাছে বোমাবর্ষণও করা হয়। উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণ করতে যে তিন দেশের জোট সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তা খোলাখুলিই বুঝিয়ে দেয় ওয়াশিংটন। দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে যে ডিমিলিটারাইজড জোন বা বাহিনী-মুক্ত অঞ্চল রয়েছে, তার খুব কাছেই বোমা হামলার মহড়া চালিয়েছে আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। আসল বোমা ফেলে হামলার মহড়াই হয়েছে।

উত্তরে কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার এই বচসা গোটা বিশ্বকে যুদ্ধের হুমকির মধ্যে ফেলেছে। বিশেষত কোরিয়ার হাতে হাইড্রোজেন বোমা থাকতে পারে এবং যুদ্ধ লাগলে তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে-এই আতঙ্ক এখন বিশ্ববাসীর জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। পরমাণু বোমার নাম শুনলেই আমাদের পিলে চমকে যায়। বুক ধড়ফড় করে। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমা তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী। তার ধ্বংসলীলা অনেক বেশি ভয়াবহ।

আজ থেকে সত্তর বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্টে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে দু’টি পরমাণু বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। সেই পরমাণু বোমার জেরে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এখনও বংশানুক্রমে অন্ধত্ব, বধিরতা ও পঙ্গুত্বের মতো নানা ধরনের জটিল অসুখ হয়ে চলেছে।

হাইড্রোজেন বোমা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। একটা বিস্ফোরণে একটা ছোট হাইড্রোজেন বোমা একটা বড় শহরকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একেবারে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে পারে। করে দিতে পারে ধু ধু মরুভূমি। সেই হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে উত্তর কোরিয়া!

২০১১’য় বাবা কিম জং ইল-এর মৃত্যুর পরে উত্তর কোরিয়ার সর্বময় কর্তা হন ছোট পুত্র উন। আশা ছিল, পশ্চিমে শিক্ষিত (সুইজারল্যান্ড) উন দীর্ঘ দিনের নির্বাসিত অবস্থা থেকে উত্তর কোরিয়াকে বের করে নিয়ে আসবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। আশা ছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নতির পথে হাঁটবেন উন। কিন্তু উন হাঁটলেন সম্পূর্ণ উল্টো পথে। নিজের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে বাবার অনুগত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সরিয়ে দিতে থাকলেন। পদত্যাগে বাধ্য করা নয়, অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড হলো। ছাড়েননি নিজের কাকা চাং সং থেক কে। অভিযোগ, থেক-কে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট বন্দুক দিয়ে হত্যা করা হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন ইয়ং চোলকে। সব মিলিয়ে উনের ‘বিষ নজর’-এ পড়ে উচ্চপদস্থ প্রায় ৭০ জন কর্মচারীর প্রাণ গিয়েছে বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধেও কড়া অবস্থান নেন উন।

উত্তর কোরিয়া যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যত নেমেছে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া, ততই নিজের অস্ত্রভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উনের হাতে প্রায় ১২ লক্ষ সেনা আছে। রিজার্ভে রয়েছে ৭৭ লক্ষ সেনা। পাশাপাশি, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ক্রমাগত শান দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বাড়িয়ে গিয়েছে। কিম জং ইলের সময় থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে উত্তর কোরিয়া। নিরাপত্তা পরিষদ একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি ক্রমেই ভঙ্গুর হয়েছে। কিন্তু পরমাণু অস্ত্রের সাধনা থেকে বিরত থাকেননি ইল।

প্রশ্ন উঠেছে, শুধু নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে উত্তর কোরিয়াকে কি আদৌ দমন করা সম্ভব? নরম-গরমের রাজনীতি করে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েই উত্তর কোরিয়া এত দূরে চলে আসার পরে কী হবে? তা হলে কী হবে উপায়? নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা।

উত্তর কোরিয়ার এই দুঃসাহসের পেছনে চীনেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। উত্তর কোরিয়া নানা সমস্যায় চীনকে পাশে পায়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক যোগাযোগ অনেকটাই চীনের হাত ধরে হয়। চীনের সাহায্যেই নানা সঙ্কটে উতরে গিয়েছে উত্তর কোরিয়া।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। পিয়ংইয়ং-এ ক্ষমতায় বসে আছেন কিম জং উন নামে এক একনায়ক। দৃশ্যত, তিনি নিজের শাসনক্ষমতার অস্তিত্বের স্বার্থে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু এই যুদ্ধে মারা যেতে পারে হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ মানুষ। পৃথিবীর অপরপ্রান্ত ওয়াশিংটনের ক্ষমতার গদিতে বসে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ভদ্রলোক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বটে, কিন্তু তার আচরণ ক্ষ্যাপাটে ব্যক্তির মতো। সিরিয়া ও আফগানিস্তানে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্রুজ মিসাইল কিংবা প্রকাণ্ড বোমা ফেলতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না।

এই দুই ব্যক্তি তাবৎ দুনিয়ার মানুষের স্নায়ু নিয়ে খেলছেন। বিভিন্ন নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জেরবার ট্রাম্প দৃশ্যত উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে বাগাড়ম্বরেই মনোযোগ সরানোর পথ বলে মনে করছেন। এক্ষেত্রে তিনি দৃশ্যত সফলও। তিনি যখন সিরিয়ায় এ মাসের শুরুতে ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন, তখন খোদ তার সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন ট্রাম্প।

ফলে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প- এ দুয়ের অর্থ হলো, ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং-এর বিবাদ এক নতুন ও অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতীতে সংঘাতের এমন সমূহ ঝুঁকি সৃষ্টির নজির বেশ বিরল। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, কোরিয়ান উপদ্বীপে যেকোনও যুদ্ধ পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। এ যুদ্ধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চেয়েও বেশি পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হবে। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, বিশ্বের তিন শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান যদি কোনও সংঘাতে জড়িয়ে যায়, তবে বিশ্ব কেবল বিপর্যয়কর এক মানবিক পরিস্থিতিই প্রত্যক্ষ করবে না, অর্থনৈতিক ধস হতে পারে অপরিমেয়।

চীন, রাশিয়াসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা কেউই যুদ্ধের পক্ষে নয় বা ট্রাম্পের হঠকারী রাস্তাকে সমর্থন করে না। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি সরাসরি ট্রাম্পের অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। দায়িত্বশীলরা সবাই মনে করছেন যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, হুমকি-পালটা হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল ও ঘোলাটে হবে। উত্তর কোরিয়ায় আমেরিকা যদি হামলা করে তবে তার সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে। মার্কিন হঠকারিতার শিকার হবে এই দুই দেশ। আসলে আমেরিকা চাইছে কোরিয়াকে খেপিয়ে দিয়ে সঙ্গী দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের আতঙ্ক তীব্র করতে। তাতে ওই দুই দেশে এবং অন্যান্য দেশে তাদের সামরিক প্রভাব আরও বাড়ানো যাবে। চীনের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকাতে এশিয়ায় আমেরিকার আরও বেশি সঙ্গী চাই। কিন্তু চীনের প্রভাব বাড়ায় বিগত সময়কালে মার্কিন রাশ অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। তাই এশিয়ায় ফের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে ট্রাম্পের আমেরিকা নতুন করে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

তাই উত্তেজনা বা সংঘাত সৃষ্টির এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে। যুদ্ধ, সংঘাত কখনোই কোনও সমস্যার সমাধান দেয় না, বরং মানবিক সমাজকে পিছিয়ে দেয়। যারা প্রকাশ্যে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ খেলছেন, আর যারা মনে মনে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ দেখতে চান তারা জানেন না যে তাদের মতো মানসিকতার লোকেরা পৃথিবীকে কতটা পিছিয়ে দিতে পারে!

লেখক: চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট