মিয়ানমারে শত বছর ধরে মুসলমান সংখ্যালঘু হিসাবে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী কিছু চরমপন্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও তাদের অন্ধ অনুসারীরা। রোহিঙ্গা নিধনের এই আয়োজন কেবল ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয়ই নয়, এর পেছনে রয়েছে বিশাল অঙ্কের ব্যবসা।
এ বছরের প্রথম দিকে এমনই এক গবেষণা তুলে ধরেছিলেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর সাসকিয়া সাসেন। ২০১৩ সালে সোশাল সায়েন্স বিষয়ে ‘প্রিন্সিপাল ডি অ্যাস্টুরিয়াস প্রাইজ’ বিজয়ী এই গবেষকের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে দ্য গার্ডিয়ান। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সেই প্রতিবেদনের সারাংশ তুলে ধরা হলো।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলা নৃশংসতাকে ভিন্নমাত্রা দেয়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে অন্য দেশে পালিয়ে যায়। আর এখন মিলিটারি বাহিনী রোহিঙ্গাদের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে হামলা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা কমপক্ষে দেড় হাজার ভবন ধ্বংস করেছে।
নিরস্ত্র নারী, পুরুষ আর শিশুকে গুলি করে মারছে।
এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে আনছে বিশ্ব মিডিয়া। এটাকে পুরোপুরি ধর্মীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্ব বলেই ধরে নিয়েছে সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় দাঙ্গা বলেই প্রচার পাচ্ছে বিষয়টি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রোহিঙ্গা নিধনের এই ঘটনাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে মন্তব্য করেছে। আর ওদিকে মিয়ানমার সরকার এটাকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ এর ক্যাম্পেইনে পরিণত করেছে।
সাসকিয়া সাসেন বলছেন, আমার গবেষণায় দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর এই নির্যাতনের পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, ধর্ম ও জাতিগত ভিন্নতার দোহাই তার একটি অংশ মাত্র। গত দুই যুগে খনিজ, কাঠ, কৃষি আর পানির জন্য ভূমি দখলের লড়াইয়ে কর্পোরেট জগত বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সেই ১৯৯০ দশক থেকে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযান চালিয়ে আসছে। তবে প্রথমে হুমকি-ধামকির মাধ্যমেই তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রত্যক্ষ নির্যাতনের মাধ্যমে শুরু করেনি তারা। দুই যুগ ধরে এমনটা চলে আসছে এবং ক্রমেই তা নৃশংসতার রূপ নেয়। বিশেষ করে শেষ কয়েক বছরে তো জমি দখলের অভিযান ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ২০১২ সালের হামলার পর বড় বড় প্রজেক্ট স্থাপনের জন্য যে পরিমাণ ভূমি দরকার ছিল, ২০১০-২০১৩ সালের মধ্যে দখলকৃত জমি বেড়েছে ১৭০ শতাংশ। ২০১২ সালে ভূমি নিয়ন্ত্রণে যে আইন প্রবর্তিত হয় তা কেবল বিশাল মাপের কর্পোরেট দখলদারিত্বকেই সমর্থন করে।
সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘুদের ভূমিকেই টার্গেট করা হয়। দখলের কারণ হিসাবে ধর্ম ও জাতিগত বিভেদকে সামনে আনা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের উন্নতিকল্পে মিয়ানমার সরকার ইতিমধ্যে ৩১ লাখ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে যার পুরোটাতেই ছিল রোহিঙ্গাদের বাস। ২০১২ সালের তুলনায় তাদের দখল দারুণ গতিতে এগিয়েছে। সেই সময় মাত্র ১৭ হাজার একর ভূমি উন্নয়নের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছিল। এই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মূলত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ভূমি ছাড়া করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কাঠ, খনিজ আর পানির বড় বড় প্রজেক্টের জন্য যে ভূমি দরকার, তা সংগ্রহে অনেক বৌদ্ধকেও বাস্তুচ্যুত করা হয়। এ ধরনের বিষয়গুলো মিডিয়াতে সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। ধর্মীয় দাঙ্গার আলোচনায় তা উহ্য রাখা হয়। বিশ্ব মিডিয়াসহ মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও রোহিঙ্গা নির্যাতনকে মূলত ধর্মীয় সংঘাত বলেই প্রচার চালানো হয়েছে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে অং সান সু চি’র পার্টি ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতা নিলে গোটা বিশ্বে তার দিকে আশাবাদ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সবাই ভাবেন যে, দেশটিতে এবার সুবিচার কায়েম হবে। কিন্তু মানুষের কাছে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে এইসব উন্নয়ন এবং উন্নয়নের পথে এগোনোর গোপন পন্থার কথা প্রকাশ পায়নি। শুধু তাই নয়, শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি ২০১৬ সালের মে মাসে আমেরিকাকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটা না ব্যবহারের অনুরোধ করেন। এতে নাকি দেশটির জন্য জাতীয় ঐক্যমতের পথে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভূমি দখলের এই পরিকল্পনার বিষয়টি কখনই পরিষ্কারভাবে উঠে আসেনি। সেনাবাহিনী সেই ৯০ এর দশকে বোদ্ধসহ অন্য গোত্রের জমিও দখলে নিয়েছিল। ২০১২ সালে আসে পরিবর্তন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আসার পথ সুগম করা হয়। ২০১২ সালের ৩০ মার্চ পার্লামেন্টের নিম্ন ও উচ্চ কক্ষ মিলে জমি বিষয়ে দুটি আইন পাশ করে। একটি কৃষি জমি বিষয়ক আইন, অন্যটি খালি জমি বিষয়ক আইন। এর মাধ্যমে বড় বড় প্রজেক্ট স্থাপনে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার খুলে দেওয়া হয়।
আর যেখানে শাসক গোষ্ঠীর ভূমি দরকার, সেখানে যুগে যুগে পৃথিবীর সবখানেই সংখ্যালঘুদের কখনো জমির মালিক বলে মেনে নেওয়া হয়নি। বর্তমানে মিয়ানমারের যেখানে খনিজ, কাঠসহ বিভিন্ন বড় বড় প্রজেক্ট স্থাপিত হয়েছে, তার পুরোটার মালিক ছিল ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো। এসব প্রজেক্টে আবার দেশের মানবসম্পদকে ব্যবহারের কোনো সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর দরকার আছে। তা ছাড়া নতুন বিনিয়োগে উৎপাদন খাতকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে শক্তিশালী কর্মজীবী ও মধ্যবিত্তদের অংশ গড়ে উঠছে না। যেমন- মিয়ানমারের ইয়াদানা পাইপলাইন্স প্রজেক্টের কথাই ধরা যাক। এতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার। অথচ এই বিশাল প্রজেক্টে কাজ করেন মাত্র ৮০০ জন কর্মী।
বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের যে আয়োজন চলছে তা নিয়ে গোটা বিশ্বে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অবস্থা আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সেনাবাহিনী কিংবা সরকারের এখন দরকার ভূমি, যা সংগ্রহ করতে সংখ্যালঘু নিধনের দিকেই মন দিয়েছে তারা। কৃষি, খনিজ আর পানির আধুনিক ব্যবস্থার উন্নয়নে মিয়ানমারকে এশিয়ার একেবারে নতুন সদস্য বলা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ এটি। তা ছাড়া চীন এবং ভারতের মতো জনবহুল দুটি দেশের মাঝে রয়েছে মিয়ানমার। ওই দুটি বড় দেশ কিন্তু খনিজের জন্য ক্ষুধার্ত।
বৈধ সরকারের অধীনে মিয়ানমারে প্রথম যে বিনিয়োগকারীরা দেশটিতে প্রবেশ করেছে, তারা এসেই খালি জমি চেয়েছে। এটাই কিন্তু রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়ানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তত বেশি জমি দরকার। আর তত বেশি রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করা জরুরি। যত মানুষ জমি হারাচ্ছে, জমির দাম ততই বাড়ছে।
বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, গুলি করে হত্যা করে, দেশছাড়া করে রোহিঙ্গাদের ভূমি দখল করা হচ্ছে। আর এ কাজে ধর্মীয় সংঘাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিকে জুড়ে দেওয়া দখলদারদের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। তবে সরকারের ভূমি সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে রোহিঙ্গারাই একমাত্রা বাধা তা কিন্তু নয়, প্রয়োজনে অন্য কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে বেছে নিতে পিছপা হবে না তারা। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার বাণিজ্যের বিশাল উৎসের সন্ধান পেয়েছে। সূত্র: গার্ডিয়ান