Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

suchi-modiভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরকালে ইয়াঙ্গুনের কালীমন্দিরে গিয়ে যেমন পুজো দিয়েছেন, তেমনি শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারও পরিদর্শন করেছেন। ঐতিহাসিক শহর বাগানের আনন্দ টেম্পলে সংস্কারের কাজ কেমন চলছে, সেটা যেমন দেখেছেন, তেমনি শেডাগনের বিখ্যাত সোনালি প্যাগোডা দেখার সময়ও বের করে নিয়েছেন। এছাড়া, দেশটির ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। দু’জন একসঙ্গে ঘুরে সু চির বাবার নামাঙ্কিত মিউজিয়ামও দেখেছেন।

কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার নিয়ে বিশ্ববিবেক তোলপাড়, সে বিষয়ে তিন দিনের সফরে নরেন্দ্র মোদি একটি কথাও বলেননি। বরং জানিয়েছেন, রাখাইনে ‘জঙ্গি সহিংসতা’ রুখতে তার সরকার সর্বতোভাবে মিয়ানমার সরকারকে সাহায্য করবে।

chardike-ad

ভারতের এই অবস্থান ও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে মোদির নীরবতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে অনেককেই হয়তো হতাশ করেছে। কিন্তু ভারতীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বাণিজ্যিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

বাংলা ট্রিবিউন বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতে একাধিক কূটনীতিক, গবেষক ও বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের মরিয়া। এ কারণেই নরেন্দ্র মোদি রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না।

কেন অং সান সু চি তথা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নটা ভারতের জন্য এত জরুরি, সেটা বরং ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা যাক।

‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসি: পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে তাকিয়ে ভারত যে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি নিয়ে এগোতে চাইছে, মিয়ানমার হলো সেই অভিযানের প্রথম স্টপেজ। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে ভারত খুবই আগ্রহী। আর সেই আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র হলো এই মিয়ানমার। বিমস্টেক জোটেও মিয়ানমার ভারতের সহযোগী, আর মিয়ানমারের মধ্যে দিয়ে ভারত একাধিক কানেক্টিভিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে। তার একটি হলো, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়ে চালু করা–যে প্রকল্পকে ঘিরে ভারতের অনেক স্বপ্ন।

২০১০-১৩ সালে যিনি মিয়ানমারে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন, সেই ভি শেষাদ্রির কথায়, ‘বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য আর কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে মিয়ানমারে ভারতের স্টেক এত বেশি যে আমরা কিছুতেই নেপিডো-র প্রশাসনের সঙ্গে কোনও তিক্ততা অ্যাফোর্ড করতে পারব না। আমাদের অ্যাক্ট ইস্ট-নীতি সফল হওয়ার প্রথম আর প্রধান শর্তই হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক।’

চীন ফ্যাক্টর: অং সান সু চি-র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সু চি স্টেট কাউন্সেলর হওয়ার পর দিল্লির অনেক আগে প্রথমে বেজিংয়েই ছুটে গিয়েছিলেন। সে দেশের বিভিন্ন সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের শান্তি আলোচনায়ও মধ্যস্থতা করছে চীন। মিয়ানমারে চীন কায়াখফু বন্দর গড়ে দিচ্ছে, কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন বসিয়ে ফেলছে। আর ভারত শুধুই হাত কামড়েছে। এই প্রসঙ্গে টাইমস অব ইন্ডিয়া’র ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর ইন্দ্রাণী বাগচী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেই পরিস্থিতিটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। মিয়ানমার এখন ভারতকে এই স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, তারা দিল্লি ও বেজিংয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলতে যায়। কারণ দুই দেশই তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। ভারত এটাকে দেখছে সে দেশে চীনা প্রভাব খর্ব করে নিজেদের পুরনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেওয়ার একটা দারুণ সুযোগ হিসেবে। সেখানে রোহিঙ্গা নির্যাতনের মতো অস্বস্তিকর ইস্যুর ছায়াপাত ঘটুক, ভারত তা অবশ্যই চাইবে না’

রাখাইনে স্থিতিশীলতা: রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারের যে রাখাইন স্টেট বিশ্বসংবাদের শিরোনামে, সেখানে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকাটা ভারতের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। কারণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার খরচ করে এই রাখাইন দিয়েই ভারত বানাচ্ছে ‘কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট’, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ গড়ে তুলবে। বাংলাদেশ কোনোদিন ভারতকে ট্রানজিট দিতে অস্বীকার করলে তার বিকল্পও হবে এই কালাদান প্রকল্প।

এই কালাদান প্রকল্পের শুরু যেখানে, রাখাইনের সেই সিটওয়ে বন্দরের কাজ ভারত অনেকটাই শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু এরপর কালাদান নদীপথের শেষে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মিজোরাম রাস্তা বানানোর কাজ অনেকটাই বাকি।

গত বছরই মিয়ানমারে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের শেষে অবসর নিয়েছেন অ্যাম্বাসেডর গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছিলেন, ‘২০১২ সালে রাখাইনে যে সহিংসতা হয়েছিল তার জন্য কালাদান প্রকল্পে বিরাট দেরি হয়ে যায়। প্রকল্পে যে মিস্ত্রি-মজদুর বা স্থানীয় প্রকৌশলীরা কাজ করছিলেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন স্থানীয় মুসলিম, হিংসা শুরু হতেই তারা পালিয়ে যেত বাধ্য হন। ফলে রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা থাকুক এটা কালাদান প্রকেল্পের স্বার্থেই ভারতের দরকার।’

ফলে নরেন্দ্র মোদি কেন কড়া ভাষায় রাখাইনে ‘জঙ্গি সহিংসতা’র নিন্দা করেছেন, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

জঙ্গিবিরোধী অভিযান: মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের শুধু বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমেই নয়, স্থলসীমান্তও রয়েছে প্রায় ১৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা। আর এই সীমান্ত অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম–এই চারটি রাজ্যজুড়ে, যার অন্য প্রান্তের গহীন জঙ্গলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জঙ্গিগোষ্ঠীরই ঘাঁটি রয়েছে।

মিয়ানমারের মাটিতে এই জঙ্গি শিবিরগুলোর বিরুদ্ধে ভারত অনেকদিন ধরেই অভিযান চালাচ্ছে। এমনকী বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভেতরে বেশ কয়েক মাইল ঢুকে পড়েও। নেপিডো প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয় বলাই বাহুল্য, আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতেই মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের এই সহযোগিতা বজায় রেখে চলা ছাড়া উপায় নেই।

দিল্লির নামী স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসেরে গবেষক গৌতম সেনের মতে, ‘নাগা জঙ্গিগোষ্ঠী এনএসসিএন (খাপলাং গ্রুপ) বা আলফার পরেশ বড়ুয়া গোষ্ঠীর মতো যারা এখনও ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ শিবির বা ঘাঁটিগুলো কিন্তু এই মিয়ানমারের জঙ্গলেই। ফলে তাদের নির্মূল করতে ভারতের জন্য মিয়ানমার ও বিশেষ করে সে দেশের সেনাবাহিনীর সাহায্যটা খুব জরুরি।’

মাসকয়েক আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান যখন টানা বেশ কয়েকদিনের জন্য ভারত সফরে এসেছিলেন, তাকে কেন অভূতপূর্ব আতিথেয়তা দিয়ে রাজার হালে রাখা হয়েছিল, সেটাও তাই সহজেই বোধগম্য।

ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বের আলোড়নকে উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদি সরকার কেন খোলাখুলি মিয়ানমারের পাশে দাঁড়াচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। নিরাপত্তা-কূটনীতি-অর্থনীতিই এই সম্পর্কে তাদের প্রধান বিবেচ্য, কয়েক হাজার রোহিঙ্গার জীবনের মূল্য সেখানে নেহাতই গৌণ!