Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

malaysiaমালয়েশিয়ার স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে গোটা কুয়ালালামপুর শহর ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। দিবসটি পালনে মারদেকা মাঠে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ৩১ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) দেশটির ৬০তম স্বাধীনতা দিবস। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম গৌরব ও অহংকারের হারি মারদেকা দিন এটি। পৃথিবীর মানচিত্রে নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ে মালয় জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে এ দিনে। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জন করে দেশটি।

মালয়েশিয়ার ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা গেছে, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়াই সর্ব প্রথম ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের যাত্রা তখন থেকেই। এরপর ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মালয়েশিয়া সফরে দু’দেশের সম্পর্ককে এক মজবুত ভিত্তিতে দাঁড় করায়।

chardike-ad

আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগেও মালয় অঞ্চলে মানুষ বসবাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। সুদূর অতীতে এ অঞ্চলে হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩ শতকে এই উপদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে। ১৫ শতকে মালাক্কান সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক কারণে মধ্য এশিয়া, ভারত ও আরবদের সঙ্গে মালয়ের সংযোগ স্থাপিত হয়।

১৫১১ সালে পর্তুগিজ নাবিক অ্যাফোনসো দ্য আলবুকার্ক এই অঞ্চলে নৌ অভিযান পরিচালনা করেন। এটাই ছিল মালয় উপদ্বীপে প্রথম ইউরোপীয় অভিযান। ১৫৭১ সালে এই অঞ্চলে স্প্যানিশদের আগমন ঘটে। ব্রিটিশরা প্রথম মালয় উপদ্বীপে আসে ১৭ শতকে। ১৮৯৫ সালে ফেডারেটেড মালয় স্টেটস গঠিত হয়। অর্থনৈতিক কারণেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ছাড়াও ডাচ ও ফরাসিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মালয়েশিয়া।

ব্রিটিশরা প্রথম বসতি স্থাপন করে মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে। প্রথম ১৮১৯ সালে মালয় উপদ্বীপে পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকার শাসক সুলতানদের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের সু-সর্ম্পক ছিল। ১৮২৪ সালে মালয়ের উপর ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্তের জন্য অ্যাংলো-ডাচ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে মালয় দ্বীপমালা দুইভাগে ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডের মধ্য ভাগ করা হয়।

১৮২৬ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা পেনাং, মালাক্কা, লাবুয়ান দ্বীপের উপর পরিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে প্রতিষ্ঠা হয় ব্রিটিশ কলোনি। ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে সরাসরি শাসন করে। ১৮৭৪ সালে স্বাক্ষরিত পাংকর চুক্তি অনুসারে বিভিন্ন রাজ্যের সুলতানরা ব্রিটিশ এলাকার শাসনের সুযোগ পায়। এসব এলাকায় ব্রিটিশরা টিন ও স্বর্ণের খনি প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়াও নানা ধরনের মসলা ও ফলের বাগান প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় রাবার চাষও শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মালয় উপত্যকা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। জাপানী আক্রমণে বিখ্যাত হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। ব্রিটিশরা চীনা, ফরাসিদের সহায়তায় মালয় অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালের ১ এপ্রিল মালয়ান ইউনিয়ন গঠিত হয়। এ সময় মালয় অঞ্চলে স্বাধিকার চেতনা জন্ম নেয়।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ফেডারেশন অব মালয় গঠিত হয়। স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য মালয় অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট টুঙ্কু আব্দুর রহমান মালয়ের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৬৩ সালে ফেডারেশন অব মালয়েশিয়া গঠিত হয়। স্বাধীনতা লাভ করলেও নবগঠিত মালয়েশিয়ার নেতাদের বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

malaysia-indipendent-day১৯৬১ সালে এই নতুন রাষ্ট্রের জন্য মালয়েশিয়া নামটি নির্ধারিত হয়। টুঙ্কু আব্দুর রহমান সিঙ্গাপুর, সাবাহ এবং সারাওয়াককে মালয়ের সঙ্গে যুক্ত করে একটি রাজ্যের প্রস্তাব করেন। অবশ্য সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালে শান্তিপূর্ণভাবে মালয়েশিয়া থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

এছাড়া নতুন রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার উত্থানে ভীত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েকবার সেনা প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয় ইন্দোনেশীয় আগ্রাসন। মালয়েশিয়ার আরেকটি আশু সংকট ছিল জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করা। মালয়েশিয়া একটি বহু জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র এবং তাদের সবাইকে একই পতাকার নিচে আনা সহজ কাজ ছিল না।

নতুন সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়ী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার পরিচালনায় স্থায়ী ক্ষমতা বরাদ্দ করা হয়। পাশাপাশি ইসলামকে জাতীয় ধর্মের সম্মান দেয়া হয় এবং মালয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তবে সংখ্যালঘু চীনারা আগে থেকেই মালয়েশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছিল। ফলে স্বাধীন মালয়েশিয়ায় নতুন করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকার নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় স্থানীয় বাসিন্দা মালয়েশিয়ানদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়।

চীনারা এর বিরোধিতা করে নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করে। ১৯৬৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী দল জয়লাভ করলে কুয়ালালামপুরে জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দুই বছর সেখানে জারি থাকে জরুরি আইন।

গত ৩ দশকে মালয়েশিয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে। যার জন্য পুরোবিশ্ব একবাক্যে ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত নেতৃত্বদানকারী মাহাথির মোহাম্মদকে একজন সফল রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজও তার দেয়া ‘ভিশন ২০২০’ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে মালয়েশিয়া।

১৯৭০ সালেও মালয়েশিয়ার অধিকাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। ১৯৭১ সালে নতুন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে মালয়েশিয়া। সেই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৯০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াতে দারিদ্র্যের হার বিস্ময়করভাবে কমে আসে।

মালয় ভাষা মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা। এখানে ইংরেজি ভাষা সার্বজনীন ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। দেশটিতে আরও প্রায় ১৩০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে চীনা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা, বুগিনীয় ভাষা, দায়াক ভাষা, জাভানীয় ভাষা এবং তামিল ভাষা উল্লেখযোগ্য।

মালয়েশিয়ার ১৩টি রাজ্য (নেগেরি) হল জোহর, কেদাহ, কেলান্তান, মেলাকা, নেগেরি সেমবিলান, পাহাং, পেরাক, পারলিস, পুলাউ, পেনাং, সাবাহ, সারাওয়াক, সেলাঙ্গর এবং তেরেঙ্গানু। আর ৩টি এলাকা- কুয়ালামলামপুর, লাবুয়ান ও পুত্রাজায়া শহরসহ একটি ফেডারেল টেরিটরি (ওয়িলাইয়াহ পেরসেকুতুয়ান)।

মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। তবে বৌদ্ধ, তাও, হিন্দু, শিখ, খ্রীস্টান এবং অন্যান্য উপজাতীয় ও সংখ্যালঘু ধর্ম স্বাধীনভাবে পালিত হয়। এখানে মালয় ও আদিবাসী মিলে রয়েছে সর্বমোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ ৬০% জনগণ। এরপর রয়েছে চীনা ২৮%, ভারতীয় ৮% এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ৪%।

এদিকে ২০১৫ সালে দেশটির স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগসহ স্বচ্ছ নির্বাচন, দুর্নীতিমুক্ত সরকার, অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও প্রতিবাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল দেশটির পাঁচটি রাজনৈতিক দল। এছাড়া আন্দোলনে সস্ত্রীক যোগ দিয়েছিলেন নাজিব রাজাকের দলের প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ।