প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে ছোট্ট একটি দ্বীপ গুয়াম। বিশ্বের বিভিন্ন অস্থির পরিস্থিতিতে এই দ্বীপ যুগ যুগ ধরে ভৌগোলিক কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে চলেছে। গুয়ামের জীবনে রয়েছে অনেক বৈপরীত্য। এখানে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে বসবাস করছে আদিবাসী চামোরো সম্প্রদায়ের লোকজন। আমরা যারা গুয়ামকে আমাদের মাতৃভূমি মনে করি, এই গুয়ামের যে বাস্তবতা, তা আমরা প্রতিমুহূর্ত টের পাই।
আমাদের ঘুম ভাঙে বর্ণিল সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে। গভীর নীল প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে থাকা সড়ক ধরে আমরা গাড়ি নিয়ে কর্মস্থলে ছুটি, তখন চোখে পড়ে বাহারি রংধনু, সঙ্গে আছে মেঘের খেলা, যা দেখতে অসাধারণ। এখানকার প্রবাল, ঝরনা, সৈকত ও সূর্যাস্ত—সব সময়ই দারুণ। এখানকার জীবনযাপন খুব সাদাসিধে। মানুষের মধ্যে রয়েছে গভীর ভালোবাসা। প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখ পর্যটক গুয়ামে ঘুরতে আসেন। বেশির ভাগই এশিয়ার। তাঁরা আসেন গুয়ামের সৌন্দর্য আর চামোরো লোকজনের উষ্ণ আতিথেয়তা উপভোগ করতে। এই পর্যটন খাতই গুয়ামের অর্থনীতির মূল শক্তি।
প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য ছাড়াও আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিনই উর্দিপরা সেনা, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিনও ঘুরে বেড়াতে দেখি। আমরা জানি, এগুলো ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। প্রতিদিনই আকাশে ওড়ে সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার। নিয়মিত চলে আন্তর্জাতিক সেনামহড়া। এই দ্বীপের প্রায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্য হলেও সেনাবাহিনীতে আছেন। এই ছোট্ট দ্বীপে আমরা মার্কিন সেনাসহ সবাই সবাইকে চিনি। মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর ঘাঁটি আছে এখানে। আমরা একসঙ্গে সবাই বাজার করি, খাওয়াদাওয়া করি।
এটাই গুয়ামের নিয়তি। প্রচুর মানুষকে আপ্যায়ন করার মতো যথেষ্ট বড় এই দ্বীপ। এখানে রয়েছে প্রচুর স্বচ্ছ পানি এবং গুরুত্বপূর্ণ গভীর পোতাশ্রয়। আর আমরা ক্ষমতার লড়াইয়ে কৌশলগত খেলায় সব সময় ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় জাপানের হামলার মুখে যুক্তরাষ্ট্র তেমন প্রতিরোধ না গড়ে আমাদের ছেড়ে দেয়। অথচ এই আক্রমণের বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পেরে মার্কিন সেনারা নিজেদের পরিবারকে আগেই নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল অল্পসংখ্যক সৈন্যের ছোট্ট একটি দল। তাদের ছিল না তেমন অস্ত্রশস্ত্র। জাপানের অধীনে দুই বছর চামোরোদের ব্যাপক নির্যাতিত হতে হয়। সে সময় এক হাজারের বেশি চামোরো নিহত হন।
সেসব দুঃসহ স্মৃতি আবার যেন আমাদের সামনে ফিরে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন একে অপরকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। সারাক্ষণই মনে হয়, গুয়ামের প্রতিটির মানুষের পিঠকে তাঁরা টার্গেট করে বসে আছেন। ৯ আগস্ট উত্তর কোরিয়া ঘোষণা দেয়, তারা গুয়ামের ২৫ মাইলের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে।
আমরা প্রায়ই এসব নেতার হুমকি-ধমকি কৌতুক ও মজার ছলে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। ফিরে যাই নিজের জীবনে। আমরা যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা খবর দেখি, সেখানে লোকজনকে বলতে শুনি, আমরা দৃঢ়, আমরা প্রাণবন্ত, আমাদের বিশ্বাসের জোরেই আমরা টিকে থাকব। মার্কিন বাহিনী এবার আমাদের রক্ষা করবে। কেননা, এখন আমরা মার্কিন নাগরিক। মনে হয় যেন পুরো বিশ্বের গণমাধ্যমই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
গুয়ামের প্রতিটি মানুষই দ্বীপের বাইরে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছে। সেই ফোনকলগুলো মন খারাপের, ভয়ের। বারবার তারা বলছে, তোমরা নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এ ধরনের কথাবার্তায় সরব। আবারও এখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, এ আশঙ্কায় লোকজনের মনে অনেক ক্ষোভ।
একজন নারী আমাকে বললেন, তাঁর ছেলে সকালে ফোন করেছিল। বলেছে, শরীরটা ভালো না। ছেলেটা গুয়ামের বাইরে থাকে। আর পুরো পরিবার গুয়ামে। এই মা বলছিলেন, ‘যদি গুয়ামে বোমা হামলায় আমরা সবাই মরে যাই, তাহলে আমার ছেলেটি পৃথিবীতে একা হয়ে যাবে।’ মা-ছেলের কথা চলে বেশ অনেকটা সময়। এরপর ছেলে জানায়, এবার তার ভালো লাগছে। এই নারী তাঁর ছেলেকে শান্তির জন্য দোয়া করতে বলেন এবং আশ্বাস দেন, আমাদের দিকে কেউ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে মার্কিন সেনারা তা আকাশেই ধ্বংস করবে।
আমার আরেক বন্ধু বলল, এই পরিস্থিতিতে চিন্তায় চিন্তায় তাঁর শরীরে ভয়ানক র্যাশ উঠেছে। তাঁর এক নাতনি আছে। সে কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড জোনে থাকা মিলিটারি স্টেশনে কাজ করে। সে ফোন করে দাদিকে জানিয়েছে, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে বাঁচতে তারা এ সপ্তাহে টিকা নিয়েছে এবং সব সময়ই প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে থাকে। আমার বন্ধু জানায়, যদি হামলা হয়, তাহলে মাত্র দুই মিনিট লাগবে ওই মিলিটারি স্টেশন হামলার শিকার হতে। এরপরও দাদিকে আশঙ্কামুক্ত করতে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, দাদি, তুমি চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ফোন রাখার পর আমার বন্ধু কান্নায় ভেঙে পড়ে, কারণ সে জানে তাঁর নাতনি খুব আতঙ্কের মধ্যে আছে, কিন্তু ওপরে ওপরে খুব সাহস দেখাচ্ছে।
এক প্রতিবেশী বললেন, একটাই জীবন। তাই ভয়হীন ও সাহসের সঙ্গে যতটা ভালো থাকা যায়, তিনি সে চেষ্টাই করবেন। আরেকজন বলেন, তিনি তাঁর জীবনটাকে এভাবে শেষ হতে দেবেন না। তিনি যেভাবে এত দিন চলে আসছিলেন, সেভাবেই চলবেন। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে।
প্রবীণ একজন আমাকে বলেন, তিনি এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সক্ষমতা সম্পর্কেও তাঁর ধারণা আছে। তিনি আরও বলেন, কেউ পারমাণবিক যুদ্ধ চায় না, কারণ এতে সবাই হারায়। তিনি মনে করেন, এখন উত্তর কোরিয়ার সরকার পরিবর্তনের সময়।
অনেকে গুয়াম নিয়ে সম্প্রতি ফক্স নিউজের প্রকাশিত খবরটি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। সেখানে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার হামলা করলে ৩ হাজার ৮৩১ জন মার্কিন আক্রান্ত হবে। কিন্তু তারা এখানকার স্থানীয় লোকজনের কথা বেমালুম চেপে গেল। এখানে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের বাস। সবাই মার্কিন নাগরিক, যদিও গুয়াম যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে কিন্তু মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। আমাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো ভোটাধিকার নেই, এমনকি কংগ্রেসেও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এ এক উভয়সংকট, যা শেষ হওয়ার নয়। ক্ষমতাহীনের যে অনুভূতি, তা যেন কুরে কুরে খায়। এই উপনিবেশবাদের চক্র থেকে বের হতে এবং জাতিগত অধিকার রক্ষায় আমরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু ততটা এগোতে পারিনি।
আমরা দেখছি, মার্কিন সেনারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের গুয়াম থেকে ফেরত পাঠাতে শুরু করে কি না। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করবে সবাই—এটাই আমাদের মনেপ্রাণে প্রত্যাশা।
লেখক: শ্যানন জে মার্ফি, গুয়ামের সাবেক সাংবাদিক, বর্তমানে গুয়ামপিডিয়াডটকমের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর: লিপি রানী সাহা
সৌজন্যে: প্রথম আলো