আব্দুল্লাহ আল রাহাত: দীর্ঘ দুই বছর কেমনে কেমনে কেটে গেল দক্ষিণ কোরিয়ায়। আগামীকাল ইন শা আল্লাহ দেশে ফিরে যাচ্ছি। স্বল্প সময়ে কোরিয়ায় যা দেখলাম তাতে প্রশংসা বোধ হয় বেশী করতে হবে।
কোরিয়ার ব্যাপারে অনুভূতি প্রকাশ করতে বললে যে কেউ প্রথমে সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলবে। মনে হয় দিনের চেয়ে রাতে চলাচল বেশী নিরাপদ! সারা বিশ্বে যখন নানা জঙ্গি হামলার স্বীকার হয়েছে তখন আইএস এর ছোবল কিন্তু কোরিয়ার গায়ে লাগেনি। যার কারণে কোরিয়াতে মুসলিমরা ইউরোপ আমেরিকার মত হেইট ক্রাইমের স্বীকার হয়নি। অবশ্যই কোরিয়ানদের খুব একটা ধর্মীয় ঘৃণা আছে বলে মনে হয় না। নতুন প্রজন্মের বেশীরভাগই সংশয়বাদী। পরিশ্রমের মাধ্যমে পার্থিব অর্জনইমূলমন্ত্র। গবেষণায় সামান্য সফলতাকেও এরা অনেক বড় অর্জন হিসাবে দেখে।
কিছুদিন আগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট এর জন্য পুলিশ স্টেশানে গিয়েছিলাম। আধা ঘন্টায় সব শেষ। আমরা দুই বন্ধু একসাথে গিয়েছিলাম। ফিসফিস করে বলছিলাম ওন(কোরিয়ান কারেন্সি) লাগবে কত? কোন পয়সা লাগেনি। এক সাপ্তাহ পরে গিয়ে নিয়ে আসতে বলল। ছবি নিয়ে যায়নি। এক পুলিশ সদস্য তাঁর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিল। নাগরিক সুবিধার এই একটি নমুনা।
১৪০০ বছর আগে একটা সোনালী সময় ছিল যখন রাতের গহীন অন্ধকারে কোন রমনী হেঁটে গেলে তাঁর মনে আল্লাহ ভয় ছাড়া অন্য কিছু থাকত না। কোরিয়ার অবস্থাও ভিন্ন প্রকৃতির একই ধরণের আউটপুট। অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য। রাত ৩টা ৪ টায়ও ল্যবে আসা-যাওয়া এখানে নরমাল ব্যাপার। রাত ৩-৪ টায় অনেক যুবতী মেয়ে মদ খেয়ে পথে পড়ে থাকে, পুলিশ তাদের নিয়ে বাসায় রেখে যায়। আপনার যে কোন প্রয়োজনে পুলিশকে কল দিবেন, পুলিশকে আপনাকে সাহায্য করতে এক পায়ে খাঁড়া থাকবে। এই পুলিশকেই তো সত্যকারে জনগণের বন্ধু বলা যায়। আমি শুধু ভাবি আর কত বেশী সুবিধা দেওয়া যায়! আর কতই মানুষের দরকার! হয়ত কোরিয়ানরা আরো চায়, চাইবে। মানুষের চাহিদার তো কোন শেষ নেই। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণের চাহিদা কমতে কমতে এখন “প্রাণে না মারলে বাঁচি অবস্থা”। পুলিশ দেখলে আগে শিশুরা ভয় পেত, এখন বৃদ্ধরাও ভয় পায়।
কোরিয়ানরা আল্লাহর ভয়ে কিংবা শুধুমাত্র মানবিকতা ও ন্যায়নিষ্টা থেকে এতটা ভদ্র হয়ে ওঠেছে তা কিন্তু নয়। মূলত এরা পথের মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় সামাজিক লোকলজ্জা ও পুলিশি হয়রানির ভয়ে অপকর্ম থেকে দূরে থাকে। মাঝে মধ্যে বৃদ্ধ নাগরিকদের মধ্যে সাধারণ আইন-কানুন(যেমন ট্রাফিক রুল) ভঙ্গ করতে দেখা যায়। অবশ্যই নতুন প্রজন্মের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ বাড়ছে। নতুন প্রজন্ম ভিন্ন ধরণের কোরিয়া উপহার দিতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে কোরিয়ান নাগরিকরা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্কের দূনীতির অভিযোগে অভিসংশনই প্রমাণ বহন করে। পার্ক পরবর্তী যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, জনগণের শক্তির কথা তাঁরা মনে রাখবে। একটি ভাল দিক হল কোরিয়ায় প্লটিং ভোট বেশী। আমাদের দেশের মত দুই প্রধান দলে বিভক্ত নয়। কোরিয়ানদের বর্তমান প্রজন্ম দলের চেয়ে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করছে যা গনতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতা চর্চার জন্য ভাল দিক।
কোরিয়ার খারাপ দিক এক বাক্যে যদি বলি, কোরিয়ান প্রফেসরগুলো যদি আরেকটু ভাল হত! কোরিয়ায় প্রফেসররাই সবচেয়ে সম্মানিত, বেশী স্যালারি পায়, কম জবাবদিহিতা আছে। সিসিটিভি না থাকলে কোরিয়া কেমন হত তা শুধু কিছু প্রফেসরদের আচরণ দেখেই বুঝা সম্ভব। প্রফেসরদের চাহিদা অনেক বেশী, সামান্য যে অর্থ দিয়ে থাকে তা দিয়ে তাঁরা ১০-১২ ঘন্টা খাঁটায়। এদের কাছে কাজের জন্য জীবিন, জীবনের জন্য কাজ নয়। কিন্তু এই পরিশ্রমই ১৯৫০ এর দশকের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দক্ষিণ কোরিয়া কিভাবে যে এত দ্রুত এল এটা অনেককে ভাবিয়ে তোলে। অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের যাদুর কাটির ছোঁয়ায় আজকের সব দিকে উন্নত কোরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে গেল, ইরাকের গেল, যেখানে জঙ্গি ছাড়া আর কোন বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। জঙ্গি সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণ হত্যার একটা লাইসেন্স পেয়ে গেল। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সৃষ্ট “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের” ফল তারাও পেতে শুরু করেছে।
কোরিয়ার বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাব-ওয়ে এর কথা বলতে হয়। সাব-ওয়ে দিয়ে শুধু পুরো সিটির যেকোন জায়গায় যাওয়া সম্ভব। বেশীর ভাগ মানুষ সাব-ওয়ে ব্যবহার করে যার কারণে যানজট তেমন দেখা যায় না। টাইম বলে দেওয়া যায় অমুক জায়গায় পোঁছাতে কত সময় লাগবে। হয়ত দেশে গেলে এই দুইটাই বেশী মিস করব। এরপরও আমার দেশ আমার গর্ব, আমার অহংকার যেখানে আমার কথা বলার স্বাধীনতা আছে, প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে থাকার সুযোগ আছে, পরিবর্তনের চেষ্টার অধিকার আছে। ভিন্ন দেশে এই সুযোগ নেই, তাদের আইন-কানুন আপনি বিনা প্রশ্নে মানতে বাধ্য, না হলে ভাগো।
দেশের খ্যাতনামা শিক্ষক ও লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে একবার প্রশ্ন করা হয়, “আমেরিকার সমৃদ্ধ ও উন্নত আয়েশী জীবন ত্যাগ করে দেশে চলে আশা কি ঠিক ছিল? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই তিনি নিয়েছিলেন। আসলে জফর ইকবাল স্যার যদি আমেরিকার থাকতেন, খ্যাতনামা বিজ্ঞানী হয়ত হতে পারতেন, নোবেল জুড়তে পারতো। কিন্তু তিনি দেশে চলে আসলেন নিজের সামর্থ্যকে দেশের জন্য ব্যবহার করার জন্য। তিনি দেশে এসে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হতে না পারলেও খ্যাতিমান লেখক হতে পেরেছেন। তাঁর অনেক ভক্ত-অনুরাগী দেশে আছে। দেশের তাত্ত্বিক ফলিসি নির্ধারণে ভুমিকা রাখছে। আমেরিকায় তিনি তা পারতেন না। দেশের অনেক খ্যাতিমান নাগরিকই ইউরোপ-আমেরিকা ছেড়ে শেষ বয়সে হলে দেশে ফিরে এসেছেন, কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছে, মাতৃভুমির সমান কিছু হতে পারেন না।
আমাদের মত রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজ্ঞানবিমুখ সরকার থাকলে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা কেবল কল্পনায় সম্ভব। সাহিত্য কল্পনার রং মাখিয়ে শেষ করা যায়, বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি শুধু কল্পনা দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য সময়, শ্রম, ধর্য্য ও অর্থের প্রয়োজন হয়। আশা করি সেই দিন বেশী দূরে নয় আমরাও কোরিয়ার মত উন্নত দেশে পরিনত হব। এর জন্য দরকার মত-পার্থক্য কমিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা। নাগরিকদের আরো সচেতন হওয়া ও সব কিছুতে “মেইড ইন বাংলাদেশ” অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের সব সমর্থ্যকে ব্যবহার করা। যতদিন পর্যন্ত আমরা গবেষণাকে প্রফেশনালি গুরুত্ব দিতে পারছি না তত বাংলাদেশের টেকসই সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। এখনো আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে পিএইচডি করা গবেষকদের উপর জিপিএ বেশী থাকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করা ব্যচেলররাই শিক্ষকতায় প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে বুঝা যায় আমাদের উচ্চশিক্ষা এখনো মুখস্থ বিদ্যায় আটকে আছে। গবেষনা এখনো আমাদের কাছে বিলাসিতা!
লেখক: আব্দুল্লাহ আল রাহাত