আমাদের দেশটা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মতো আচরণ করে কিংবা ওই দেশটিকে অনুসরণ করে। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক ট্যাবু এসবের বাইরেও সৌদির সাথে আমাদের দেশের কিছু মানুষের আচরণগত মিলের জায়গাটি হচ্ছে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের বিষয়টিতে। আরবের এ দেশটিতে গৃহপরিচারিকাদের ওপর করা হয় শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন।
২০১৫ সালে সৌদি ও বাংলাদেশের মধ্যে গৃহকর্মী নেয়ার এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশটি ২ লাখ নারীকর্মীর বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছে ২০ হাজার ৯শ ৫২ জন নারীকর্মী। তবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সৌদিতে যে সংখ্যায় গৃহকর্মী পাঠানো হচ্ছে তার থেকে বরঞ্চ বেশি পরিমাণ সংখ্যক কর্মী দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী।
সম্প্রতি সৌদি থেকে ফিরে আসা হবিগঞ্জের এক তরুণী গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, বেতনের তুলনায় অতিরিক্ত কাজ করিয়েই ক্ষান্ত হতো না গৃহের মালিক, কথায় কথায় মারধর, নির্যাতন আর যখন তখন অবিবেচকের মতো গৃহপরিচারিকাদের রুমে ঢুকে যাওয়ার দোষও ছিলো উল্লেখযোগ্য।
এসব নির্যাতনের খবর আমরা হরহামেশাই গণমাধ্যমগুলোর মারফত পেয়ে থাকি আর সময়ের প্রয়োজনে অন্য খবরকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তা আবার তলিয়েও যেতেও দেখি। উল্লেখ করার মতো কোন আইনি ব্যবস্থা কিংবা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে কিনা দেশটির বিপক্ষে কিংবা সামনে তা আমার জানা নেই।
গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের বিষয়ে যে সৌদির বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ তাদেরই কিনা জাতিসংঘ নির্বাচিত করেছে লিঙ্গসমতা, নারী উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষার্থে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুরো বিশ্বে কাজ করবার জন্যে। অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো হয়েছে বিষয়টি।
যাই হোক এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে না টপকে বরঞ্চ মূল কথায় আসি। আমাদের দেশের মানুষ যারা দু’বেলার খাবার জোগাড় করতে গিয়ে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাড়ি জমাচ্ছে সৌদিতে আর সেখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হচ্ছে তাদের জন্য সরকার কী করছে? তাদের কী পুনরায় কর্মসংস্থানের কোন সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে কিংবা করা হচ্ছে পুনর্বাসিত?
এমনকি মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কী কোন ধরনের নূন্যতম চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ট্রমা থেকে বের হয়ে আসার জন্য? দেশে তো অনেক অনেক মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে।
তারা কি কখনো নিজ দায়িত্বে বা উদ্যোগে সেই নির্দিষ্ট দেশটির প্রতি অভিযোগ এনেছে বা আনার চেষ্টা করেছে? কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিযোগ আনা মানে সে বিষয়টির সুনির্দিষ্ট কোন সমাধান খোঁজা। তার মানে কি আমরা এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনও কথাই বলবো না আর গরীব মানুষগুলোকে নির্যাতিত হতে দেখবো?
অনেক মানবাধিকার সংগঠনই হয়তো কোন লিখিত অভিযোগ জানাতে চাইবে না কারণ তাদের কাছে একটি মোটা অংকের ফান্ড আসে সে দেশটি থেকে। সালমা, রহিমা, মামুন এমন শত শত মানুষ দিনের পর দিন মার খেয়ে যাচ্ছে আর আমরা শুধু তা চেয়ে চেয়ে দেখেই যাচ্ছি।
যতদূর জানি, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কোনও দেশের প্রতি কোন অভিযোগ থাকলে তা সে দেশের হাই কমিশন থেকে লিখিতভাবে দেয়া হয়ে থাকে। সৌদিতে তো আমাদের দেশের হাই কমিশন আছে, তারা কি কোনদিন কিংবা কোনওভাবে কোনও ধরনের লিখিত অভিযোগ দিয়েছে সে দেশটির কাছে? আদৌ মনে হচ্ছে না, তবে এ ধরনের পদক্ষেপ চালু করলে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো।
তবে এটাও ঠিক, অভিযোগ দায়ের না করলেও, গৃহকর্মীদের উদ্ধার করে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা ঠিকই নিচ্ছে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন। তবে কি, এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ সোচ্চার না করলে তার সুনির্দিষ্ট কোন সমাধান হবে না।
যেসব নির্যাতিতদের দেশে পাঠানো হচ্ছে তাদের কি কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে কিংবা কোন চিকিৎসা খরচ বহন করা হচ্ছে কি? আমার স্বল্পজ্ঞানে মনে হচ্ছে উত্তরটি না তবে আশা রাখতে দোষ কি?
হয়তো আমাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভাবছে, কী দরকার ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বড় ভাইকে (সৌদি আরব) ক্ষেপানোর, এমনিতেই তো দেশটি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। এখন যদি তাদের নামে কোন অভিযোগ করা হয় তবে তো হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পরে দেখা যাবে, ‘বড় ভাই’ বাংলাদেশ থেকে আর কোন হজযাত্রী নেবে না (ইরানের ক্ষেত্রে যেমনটি নিষেধাজ্ঞা আছে) নয়তো বাংলাদেশি কর্মীদের জোর করে সে দেশ থেকে বের করে দেবে।
এমনকি ওআইসির মতো সংগঠনের সদস্যপদ হারানোর শঙ্কা কিংবা জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি আমাদের দেশের মনে ঘুরপাক খায়। গৃহস্থালীর কাজে হয়তো গৃহকর্মীদের একটু নির্যাতনই করলো, মেরে তো আর ফেলিনি তাই ওইসব নির্যাতিত গরীব মানুষদের বিষয়ে চিন্তা না করে বরঞ্চ তেল মাথায় আরেকটু তেল দিলে নিজের দেশে আরেকটু উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকবে, এই ভেবেই হয়তো নির্যাতনের নির্বাক আমাদের দেশ ও সংগঠনগুলো।
সবশেষে আরেকটি কথা, গৃহকর্মী হিসেবে যদি জনশক্তি রপ্তানি করতেই হয় তবে কেনো সেই দেশেই নিয়োগ দেয়া হবে যেখানে আমাদের দেশের কর্মীরা নির্যাতিত হচ্ছে আর মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানি আমাদের দেশের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ওইসব দেশের কাছেও মূল্য বহন করে যারা জনশক্তি আমদানি করে। কারণ তাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে জনশক্তির অভাব রয়েছে বলেই বাধ্য হয়েই তারা অন্য দেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করে। তাই আমাদের চেয়েও তাদের ঠেকা কিংবা অভাব বোধ করি বেশি।
তাই এখন থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে আমাদের দেশকে যাতে কোন ধরনের অমূলক ছাড় দিতে না হয় সেদিকটা বোধহয় খেয়াল করার সময় এসেছে। সেই সাথে অন্য কোন দেশে গৃহকর্মী কিংবা জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা যায় কিনা তার ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ, কথাটি হয়তো ভুলে যাইনি আমরা কেউই।
এখন আমরা চুপ আছি সব নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার অর্থ এই দাঁড়ালো যে, দেশের কর্মীরা বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হচ্ছে আর তাতে দেশের কোন মাথাব্যথা নেই আর সেই সাথে আছে নীরব সম্মতিও। কতদিন আর তা আমরা নিশ্চুপ থেকে মেনে নেবো?
লিখেছেন: শারমিন জান্নাত ভুট্টো, সৌজন্যে: বিডিনিউজ