উদ্যোগের শুরুতে ফেইসবুক পাশে পেয়েছিল সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হর্সলি ব্রিজ পার্টনারসকে। ফেইসবুক কতটুকু বিনিয়োগ পাওয়ার যোগ্য তা মূল্যায়ন করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অর্থ পরিচালক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টিনা জাবীন। গুগল, টু্ইটার, উবার, লিফট, এয়ারবিএনবির মতো বিশ্বখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানে হর্সলি ব্রিজ পার্টনারসের বিনিয়োগের মূল্যায়নেও অংশ নিয়েছেন তিনি। এখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিলে খুঁজে বের করছেন দেশি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। এসব নিয়েই কথা বলেছেন আল আমীন দেওয়ানের সঙ্গে।
সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠিত অবস্থান ছেড়ে বাংলাদেশে কাজ করার সিদ্ধান্তের পেছনে অনুপ্রেরণা?
বাংলাদেশে আসা এবং দেশের জন্য কাজ করা ছিল স্বপ্ন। বলব না যে ত্যাগ বা আপস করেছি। শিক্ষাজীবন থেকে কর্মজীবন—২৮ বছর সিলিকন ভ্যালিতেই কাটিয়েছি। সব সময়ই ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে আসব। যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, শর্তই থাকত যে বাংলাদেশে এক মাসের জন্য যাব।
দেশে আসব বলে গত ৩০ বছর নিজেকে প্রস্তুত করেছি। সেখানে অবসর নিয়েই এরপর দেশে এসেছি। দেশে আমার চাওয়া খুব কম ছিল। আমার মতো অনেকেই দেশের জন্য কাজ করতে উদ্গ্রীব; বিশেষ করে সিলিকন ভ্যালিতে যাঁরা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রয়েছেন। এরই মধ্যে অনেকে দেশের নানা কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
দেশে শুরুটা কেমন মনে হচ্ছে?
কাজের পরিবেশটা করে নিতে হয়। এটা আগে থেকে ঠিক থাকে না। তবে তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ সরাসরি দেখভাল করেন, খোঁজ নেন। এতে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর পর দেশের জন্য কাজ করতে পারছি, এটাই সবচেয়ে বেশি আনন্দের।
বাংলাদেশে আপনার মূল কাজ কী?
বাংলাদেশ সরকারের ভিশন-২০২১ রয়েছে। লক্ষ্য এই সময়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এই লক্ষ্য অর্জনে তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগ এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ লক্ষ্য অর্জনেরই একটি প্রকল্প ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’। আমি এই প্রকল্পে যুক্ত।
তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের সমর্থন ও সহায়তা করাই স্টার্টআপ বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। সহায়তা আর্থিক হতে পারে, হতে পারে দক্ষতা বা যোগাযোগেও। অর্থাৎ একটি আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ধরনের সহায়তাই আমরা দেব। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে সিলিকল ভ্যালির আদলে বিনিয়োগের পরিবেশ ও সংস্কৃতি তৈরি করা।
সিলিকন ভ্যালি এবং বাংলাদেশ, কর্মপরিবেশে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য কোথায়?
কাজের সংস্কৃতিতে বেশ পার্থক্য আছে। সিলিকন ভ্যালিতে একটা কাঠামোগত পদ্ধতিতে কাজ হয়। সেখানে কাজ বাস্তবায়নে গতি থাকে অনেক। যেটা যে সময়ের মধ্যে হওয়ার কথা, ঠিক সে সময়ই হয়।
বাংলাদেশে বিষয়টা ভিন্ন। এখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও কাঙ্ক্ষিত সময়ে কাজ হয় না। গতি একটু ধীর। পেশাদারির ক্ষেত্রে বিষয়টা সমস্যা তৈরি করে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে কাজ করার চেষ্টা থাকলেও কখনো কখনো তা সম্ভব হয় না। কারণ সরকারি কাজে পদ্ধতিগত কিছু বিষয় থাকে, অনেক নিয়মকানুন থাকে। এটা দোষের কিছু না, তবে সংস্কৃতিটাই এমন।
আমি ছয় মাস হলো কাজ শুরু করেছি। এখানে কোনো কাজ হতে যৌক্তিক সময়ের চেয়ে বেশি লাগে।
‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ নিয়ে কতটুকু এগোতে পেরেছেন?
প্রকল্প শুরু হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার তহবিলে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নগদ। অন্যান্য খাত বা রিসোর্স মিলিয়ে বাকিটা। এটা কিন্তু আর্থিক সাহায্য হিসেবে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার এখানে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট’-এর ভূমিকা পালন করবে। মানে সরকার হবে উদ্যোগগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদার। আইডিয়া পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। বেশির ভাগই যাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল মডেল অনুসরণ করে।
এ ক্ষেত্রে কৌশলটা কী?
স্টার্টআপ বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে এরই মধ্যে দুই শর মতো আইডিয়া জমা পড়েছে। এখানে কেউ পাঁচ লাখ, কেউ ১০ লাখ, কেউ বা কোটি টাকা চেয়েছেন। এর মধ্য থেকে কাকে নির্বাচন করা হবে, কাকে কত টাকা দেওয়া হবে, এরপর তাঁদের কাজের দেখভাল কিভাবে করা হবে—এসব বিষয় একটি জায়গায় আনতে হবে। তাই আমাদের দরকার ‘বিনিয়োগ কৌশল নীতিমালা’। এই কয়েক মাসে এসব নিয়েই কাজ করেছি।
পাশাপাশি সিলিকন ভ্যালিতে স্টার্টআপ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের কাজটি করা হয়েছে। সেই আয়োজনে সিলিকন ভ্যালির সফল উদ্যোক্তারা এসেছেন। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো এসেছে। গুগল, ফেইসবুক, উবারের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও এসেছেন। আমরা ওদের সঙ্গেও অংশীদারি তৈরি করতে চাই। দেশের বাইরে এ ধরনের আয়োজন এটাই প্রথম। ওখানে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করা গেছে। এখন সিলিকন ভ্যালির সবাই জানে যে বাংলাদেশে কিছু একটা হচ্ছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ অনেক কিছু করছে। তাই তারাও বিনিয়োগ করতে চায়।
আমরা ওখানকার কিছু একাডেমির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি। যেমন—ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসের (এমআইটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফিনটেকের তথ্য বিশ্লেষক ডেভিড এম শায়ারের মতো ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে এসে আইডিয়া উপস্থাপন করছেন। যার অর্থ, আমরা বিশ্বে গুরুত্ব পাচ্ছি।
এমন অনেক কিছুই হচ্ছে। বাংলাদেশের নাম গার্মেন্টে সবাই চেনে। পাশাপাশি এখানে যে একটা আইটি ডেস্টিনেশন হবে এবং আমরা যে এর জন্য উঠেপড়ে লেগেছি—এই খবরটাও কিন্তু বড় বড় জায়গায় পৌঁছেছে। বিশ্বের মানুষ জানছে যে বাংলাদেশ আসছে।
দেশের স্টার্টআপগুলোর জন্য সরকারের এই বিনিয়োগ নিয়ে বিস্তারিত বলুন।
সাধারণ হিসাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল মডেলে ১০টি আইডিয়ায় বিনিয়োগ করলে একটি সফল হয়। আর এই সফল দুটিই অনেক গুণ বেশি ফেরত দেয়। এখন ওই যে ৯টি আইডিয়া সফল হবে না বা হারিয়ে যাবে, ব্যাংক তো এই সমীকরণ জানেই! তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা বিনিয়োগ করে না।
অন্যদিকে সরকার জেনেই করছে যে ২০০টিতে দুই বছর বিনিয়োগ করলে সেখান থেকে ৫ বা ১০টি উঠে আসবে। যদি একটিও বিশ্বমানের হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে, সেটাই সরকারের সফলতা। অন্যদিকে এমন উদাহরণ তৈরি হলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও তথ্য-প্রযুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
আমরা দ্রুত বিনিয়োগ করতে চাই। এখানে কোনো সীমা নেই। যোগ্য হলে বিনিয়োগ কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা যোগ্য প্রতিষ্ঠান বা আইডিয়া খুঁজে পাওয়া। যেহেতু চলতি বছর এটা শুরু হয়েছে আর বছর শেষে যদি ২৫টি কম্পানিকে বিনিয়োগ করানো যায়, সেটাও কাজের হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান কয়েক লাখ, আবার কেউ কয়েক কোটি টাকা পেতে পারে। পরিমাণটা নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বুঝে।
কোনো আইডিয়া বা প্রতিষ্ঠান কি বাছাই করতে পেরেছেন?
১০টির মতো আইডিয়া ও উদ্যোগ নির্বাচন করা হয়েছে। এখানে যোগ্যতা অনুযায়ী সাহায্য পাবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নের ধাপে ধাপে অর্থ পাবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসেবে সরকারের অংশীদারি থাকতে পারে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ। তবে বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান বা আইডিয়া নির্বাচনে সরকার থাকছে না। সেখানে নির্বাচন কমিটি রয়েছে। এর সদস্য দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ ও খ্যাতিমান ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন মাস পর পর মূল্যায়ন করা হবে। টাকা খরচের সব হিসাব তো দিতেই হবে।
বাংলাদেশ ও সিলিকন ভ্যালির পার্থক্য কতখানি?
আমি হর্সলি ব্রিজ পার্টনারসে কাজ করতাম। আমরা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করতাম। আর ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো স্টার্টআপদের বিনিয়োগ করত। প্রায় চার হাজার স্টার্টআপ কম্পানি দেখা বা মূল্যায়নের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। এরা সবাই সিলিকন ভ্যালি বা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান। ফেইসবুক তার একটি। রয়েছে গুগল, টু্ইটার, উবার, লিফট, এয়ারবিএনবির মতো অনেকে।
আসলে সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপগুলো শুরুই করে অনেক উচ্চ অবস্থান থেকে। ওদের স্টার্টআপ সংস্কৃতিটাই আলাদা। ওদের পরামর্শকরা হলেন স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাইস, যাঁরা খুবই সফল ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। আরো রয়েছেন ইউসি বার্কলি, সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন অ্যালামনাইস। আলাদা করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী তো আছেনই। ওখানকার উদ্যোগগুলো সিলিকন ভ্যালিতে বড় হওয়ার আবহেই জন্মায়।
অন্যদিকে আমাদের দেশের উদাহরণ দিতে পারি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কানেক্টিং স্টার্টআপসের সেরা ১০-এর একটির আইডিয়াটা খুব ভালো। অথচ তারা ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারছে না। কারণ পরিবেশ বা আবহ। সিলিকন ভ্যালি ও এখানকার এই আবহ ও সংস্কৃতির পার্থক্যই অবস্থানটা অনেকখানি ঠিক করে দেয়।
এই পার্থক্য ঘুচবে কিভাবে?
আমরা দেশে বসেই উদ্যোক্তাদের সিলিকন ভ্যালির আবহ ও সুযোগটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেমন—এয়ারবিএনবিকে যে মানের পরামর্শক দেখভাল করছেন, আমরা ওই মানের পরামর্শক দেশে আনছি। এরই মধ্যে সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহমুদ হুসাইন এসেছেন। তিনি আমাদের উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে গেছেন। আরো এসেছেন সিলিকন ভ্যালির সফল উদ্যোক্তা ইউসুফ হক। পরামর্শ দিয়ে সঙ্গে আছেন মাইক্রোসফট অ্যালামনাই আজহারও। এটা চলতেই থাকবে। এখন আমাদের কাজগুলো বাস্তবায়ন করে ফলাফল দেখাতে হবে।
আমাদের ভালো একটি দিক হলো, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগ নানা উদ্যোগে বিরামহীন কাজ করছে। আর এ সবকিছুর সমন্বয়ে সফলতা আসবেই। কালের কণ্ঠ