পৃথিবীতে সবথেকে বিপজ্জনক হল জাহাজ ভাঙার কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ, জাহাজের ভেঙে পড়া অংশ এবং বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রতি বছর কয়েক ডজন শ্রমিক প্রাণ হারান।
গত বছর এ কাজ করতে গিয়ে ৫২ জন লোক নিহত হয়েছেন। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা উঠে না আসায় অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। কারণ মালিকপক্ষ তাদের শ্রমিকের প্রাণহানির সংবাদ এবং সংখ্যা সবসময় গোপন রাখার চেষ্টা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে চার পাউন্ডের বেশি মজুরি পান না। অথচ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এসব কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে।
স্কটল্যান্ডের টেলিভিশন চ্যানেল এসটিভি নিউজ এ সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে স্কটল্যান্ডেরও সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেছে।
তালিকায় উঠে আসা ১৫০ টি ভাঙা জাহাজের মধ্যে গ্লাসগো নির্মিত এবং ব্রিটেনের রানি কর্তৃক উদ্বোধন করা ১৯৫৫ সালের ইমপ্রেসও রয়েছে।
ছয়শ ফুট লম্বা ওই জাহাজে এক হাজার যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ছিল। আটলান্টিক পার করতে জাহাজটি সপ্তাহের বেশি সময় নিত। গত ৫০ বছরে ছয়জনের কাছে জাহাজটির মালিকানা পরিবর্তন হয়। এই সময়ে বেশ কয়েকবার নামও পরিবর্তন করা হয়।
এক দুর্ঘটনার পর ২০০৮ সালে এসে জাহাজটির সর্বশেষ মালিক সিদ্ধান্ত নেন, বয়স ফুরিয়ে এসেছে। তিনি জাহাজটি বিক্রি করে দেবেন।
ওই বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে এক ভারতীয় ইমপ্রেস কিনে নেন। পরে জাহাজটি ভাঙা শুরু করেন তিনি। জাহাজটির একেক অংশ তিনি একেক কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন। অথচ পুরো জাহাজ ভাঙার কাজটি চলতে থাকে হাতে এবং ছোট আকারের মেশিনের সাহায্যে।
এভাবে ২৫ হাজার টন যন্ত্রাংশ আলাদা আলাদা করা হয়। তার মধ্যে দামি অংশগুলো পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজের পুরোটা সময় শ্রুমকদের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
সর্বশেষ বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙার কাজ চলছে। গ্লোবাল শ্রম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান (জিএলএইচআর) সেখানকার এক শ্রমিকের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, কখনও কখনও সরকারি লোকজন জাহাজ ভাঙার কাজ দেখতে অাসে। কেবল সেসময় আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু জিনিসপত্র দেয়া হয়।
ওই শ্রমিক আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে আবার সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি কেউ আহত হলে তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা এমনকি সারাদিন অপেক্ষা করতে হয়।
শিশু শ্রমিকদের দিয়ে জাহাজ ভাঙার কাজ করানো আরেক সমস্যা। ১৯৬০ সাল থেকে জাহাজ ভাঙার কাজ করে আসা শ্রমিক জ্যামি ওয়েবস্টার বলেন, এখন তারা যে বিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে কাজ করে, ৪০ বছর আগে আমরা আরও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছি।
তিনি আরও বলেন, তারা তো কেবল মারা যাচ্ছে! ধরেন জাহাজের উপর থেকে পড়ে কিংবা উপর থেকে তাদের ওপর কিছু পড়ে মারা যাচ্ছে। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বে এই ব্যাপারগুলো সমর্থন করা হয় না। জাহাজ ভাঙার শ্রমিকরা তো আকাশের চাঁদের মত। বিচ্ছিরি পরিস্থিতি ছিল আগে।
এখন শ্রমিকরা কাজ শুরুর আগে মাসিক এমনকি অগ্রিম অনেক টাকা নেন। তবে নিজের জীবন বিপন্ন করে কারও কাজে যাওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
গত বছর পাকিস্তানে জাহাজ ভাঙার সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২৮ জন নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়েছিল। সেই আগুন চারদিন ধরে জ্বলেছিল। অথচ নিহতদের পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে ১১ হাজার পাউন্ড ।
বাংলাদেশে একই গ্রামের দুই বন্ধু জাহাজ ভাঙার কাজ করতে গিয়ে মারা পড়েছেন। তাদের সেই মৃত্যুর ঘটনায় পরিবার দুটোরও মৃত্যু হয়েছে বলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারণ তারা দু’জন ওই পরিবার দুটোর প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি। সেকারণে তখন তারা মারা গেছে আর এখন তাদের পরিবার ধুকে ধুকে মরতে বসেছে।
ভারতে ইমপ্রেস জাহাজ ভেঙে চার মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেছে মালিক পক্ষ। অথচ শ্রমিকদের পিছনে ঘণ্টায় ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৩০ পাউন্ড। বাংলাদেশের চট্টগ্রামেরও অবস্থাও অভিন্ন।
সেখানকার এক শ্রমিক জানান, ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে সারাদিন কাজ করে মাত্র ৩ দশমিক ৫৩ পাউন্ড পাই। যারা সহকারী তাদের তো ২ দশমিক ২৬ পাউন্ড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ দিনের পর দিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ কাজ করে যেতে হচ্ছে।
সচরাচর দালালের সহায়তায় জাহাজগুলো বিক্রি করা হয়। মালিকের কাছ থেকে জাহাজ বিক্রির মূল্যের ধারণা নিয়ে তারা খদ্দের খুঁজতে থাকেন। বেশিরভাগ সময় লেনদেন হয় নগদে।
কিনে নেয়ার পর মালিক ওই জাহাজের নাম, পতাকা পরিবর্তন করে ফেলেন। অনেক সময় কেনাবেচার সময় নাম পরিবর্তনের শর্তও থাকার কথা জানা যায়।
পরিবেশবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, জাহাজ ভাঙা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। জাহাজ ভাঙার ফলে পরিবেশ যেমন দূষিত হয়, ওই এলাকার বন্যপ্রাণী অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়।
ব্রাসেলসভিত্তিক জাহাজ ভাঙার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইংভিল্ড জেনসেন বলেন, এর দায়ভার সম্পূর্ণভাবে জাহাজের মালিকদের ঘাড়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের জন্য আরও ভাল সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া এই কাজগুলো আরও সুরক্ষিত প্লাটফর্মে করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের করা এ সংক্রান্ত নতুন আইন আগামী বছর চালু হবে। এর ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো কিছুটা হলেও নিশ্চিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিরও পরবর্তী সময়ে উন্নতি ঘটতে পারে। অনেকগুলো জাহাজ এখানে ভাঙার অাশঙ্কা রয়েছে। সেগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে নিয়ে আসা হবে।
গত বছর ভারতে নতুন করে চারটি জাহাজ চালু করা হয়েছে। ব্রিটেনে চালু করা হয়েছে ছয়টি। দেশটির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করবেন।
জাহাজ তৈরি শিল্পে জড়িত ওয়েবস্টার বলেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমি জাহাজ তৈরির কারখানায় এসেছি। এটা সত্যিই বিস্ময়কর একটা জায়গা।
তবে জঘন্যরকম নোংরা জায়গা আর ব্যাপক দূষণ এখানে। এখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হলেও এখানকার লোকজন অনেক ভাল। সবাই মিলে অনেক সুন্দর জাহাজ আমরা এখান থেকেই তৈরি করি।
অনেক গুলো খারাপের মধ্যে অন্তত হাফ ছেড়ে বাঁচার জায়গা সেটুকুই।
সূত্র : এসটিভি নিউজ