রোববার, মধ্য দুপুর। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) পুরনো মর্গ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে মর্গসংলগ্ন সরু গলিতে মর্গ সহকারীর পেছনে পেছনে এগিয়ে যান তিনি। প্রখর রোদে বাইরে আলো থাকলেও গলিপথের শেষে আবছা অন্ধকার। এক চিলতে বারান্দার ভেতরে উঁচু সিলিংয়ে মিটমিট করে জ্বলছে আনুমানিক ৪০ ওয়াটের একটি বাতি।
বারান্দাসংলগ্ন একটি তালাবদ্ধ কক্ষের পাশে দাঁড়ালেন তারা। মর্গ সহকারী চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলতেই নাকে-মুখে রুমাল চেপে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কক্ষের ভেতর তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক। ভেতরে নবজাতক ও নারীসহ অসংখ্য লাশের স্তূপ। মর্গ সহকারী লাশগুলো দেখিয়ে তার স্বজনের লাশ সেখানে আছে কি না জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলেন ভদ্রলোক। কক্ষটি তালাবদ্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন দুজন। বাইরে এসে ভদ্রলোক ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে উদ্যত হলেন।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে উত্তরার বাসিন্দা ওই ভদ্রলোক জানান, তার এক নিকটাত্মীয় কয়েকদিন আগে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যান। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত মর্গে এসেছেন। মর্গে বিপুলসংখ্যক বেওয়ারিশ লাশ দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রায় পচাগলা লাশগুলো দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ যেন বেওয়ারিশ লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছে। গত এক সপ্তাহেরও কম সময়ে মর্গে কমপক্ষে ৩০টি অজ্ঞাত লাশ এসেছে। এর মধ্যে ১৫টি ঢামেক হাসপাতালে জন্ম নেয়া মৃত নবজাতক ছাড়াও তিন নারী ও ১২ পুরুষ রয়েছেন।
মর্গের মরচুয়ারি কুলারে সীমিতসংখ্যক লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় অজ্ঞাত লাশ কুলারে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একটি কক্ষে লাশগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের বেশি সময় লাশগুলো ফেলে রাখায় তাতে পচন ধরে মর্গের চৌহদ্দিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চারপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
মর্গে এত লাশ পড়ে থাকার নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের একজন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, হাসপাতাল কিংবা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অজ্ঞাত লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিচয় খুঁজে পেতে লাশ কয়েকদিন মর্গে রাখা হয়। মর্গে রাখার পরও পরিচয় শনাক্ত না হলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ হিসেবে তা দাফন করে। কিন্তু ঈদের পর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লোকজন লাশগুলো না নেয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাকরাইল অফিসে যোগাযোগ করা হলে ঈদের ছুটির কারণে লাশগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বলে জানায়। আগামী দু-একদিনের মধ্যে তারা লাশগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
তবে ভিন্ন একটি সূত্র জানায়, জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশগুলো দাফন করা হয়। বৃষ্টির কারণে কবরে পানি ওঠায় কর্তৃপক্ষ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে গড়িমসি করছে।
ঢামেক মর্গের মরচুয়ারি অ্যাসিস্ট্যান্ট সিকান্দার আলী প্রায় ৩০টি বেওয়ারিশ লাশ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ঈদের আগে আরও একবার ১১টি লাশ পড়েছিল। পরে সেগুলো নিয়ে দাফন করা হয়। ঈদের পর আর কেউ লাশ নিতে আসেনি। লাশগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
জুরাইন কবরস্থানের মোহরার মো. শোয়েব হোসাইনের কাছে বেওয়ারিশ লাশ দাফন না করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুরাইন কবরস্থানে মোট ১৭ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ একর ব্যক্তিমালিকানার কবর। এছাড়া পাঁচ একর জমিতে অবশিষ্ট লাশ কবর দেয়া হয়। বছরের পর বছর কবর দেয়ায় সেখানে জায়গাও নেই। গেন্ডারিয়া বাজারসংশ্লিষ্ট অবশিষ্ট সাড়ে সাত একর জমিতে বর্তমানে লাশ দাফন করা হয়। সেখানে বেওয়ারিশ লাশও দাফন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্ষা মৌসুমে এখানে লাশ দাফনের জন্য মাটি খোঁড়া যায় না। একটু মাটি খুঁড়লেই পানি ওঠে। এ কারণে গোরখোদকরাও কবর খুঁড়তে রাজি হন না। ফলে বর্ষার তিন মাস রাজধানীর অন্য কোনো কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করতে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানানো হয়। এরপরও রোজার মাসে তাদের অনুরোধে কয়েকটি লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। এমনও দেখা গেছে, অতি বৃষ্টির কারণে লাশগুলো পানিতে ভেসে ওঠে- জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থান যেমন আজিমপুরে ৩৩ একর, মোহাম্মদপুরের বসিলায় ৮০ একর ও মিরপুর কবরস্থানে ৬০ একর জমি রয়েছে। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র- এ তিন মাস ওইসব কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের বিকল্প ব্যবস্থা করা উচিত। জাগোনিউজ