Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
NuclearWarHeader
প্রতীকী ছবি

যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যকার বর্তমান বাগযুদ্ধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সামরিক সজ্জা যেকোনো সময় বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হতে পারে। এ যুদ্ধ শুরু হতে পারে সমুদ্রে, আকাশে ছোট ছোট সঙ্ঘাতের মাধ্যমে অসামরিকীকরণ এলাকায়, যা দুই কোরিয়াকে পৃথক করেছে।
২০১৩ সালের এপ্রিলেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। উভয় পক্ষ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কোরিয়া উপদ্বীপে সঙ্ঘাত বাধেনি। যুক্তরাষ্ট্রে এখন ক্ষমতায় ট্রাম্প। তিনি ইতোমধ্যেই উত্তর কোরিয়াকে বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ঠেকাতে চীন যদি সহযোগিতা না করে তাহলে পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে তার দেশ একাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ আছে। অবরোধ সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরীক্ষার ওপর জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও এবার মার্চেও দেশটি চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যেগুলো এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জাপানের পানি সীমায় গিয়ে পড়ে। এরপর জাপানও ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরির কাজ শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতিতে রাখা হয়েছে। পরমাণু হামলা প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণের জন্য সেনা ও বিমানবাহিনীকে দ্রুত সজ্জিত করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এখন পর্যন্ত পাঁচ দফা পরমাণু বোমার পরীক্ষা করেছে পিয়ংইয়ং। শুধু তাই নয়, একাধিকবার মিসাইলের পরীক্ষাও করেছে উত্তর কোরিয়া। সামরিক পর্যবেক্ষকরা একে যুদ্ধের প্রস্তুতি মনে করছেন। এসব পরীক্ষা চলাকালে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন বলেন, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার দেশ আমেরিকার দুই কোটি মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে।

chardike-ad

সিরিয়ায় বিমান হামলা চালানোর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেট রেক্স টিলারসন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যেকোনো দেশ আন্তর্জাতিক নিয়ম ভাঙলেই এমন কড়া জবাব দেয়া হবে সিরিয়ার স্ট্রাইক থেকে এ শিক্ষা নেয়া উচিত সব দেশের। তিনি জানান, যদি কোনো দেশ অন্য দেশের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে, প্রতিশ্রুতি বজায় না রাখতে পারে, তাহলে এ রকম ব্যবস্থাই নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, কোরিয়া উপদ্বীপ পরমাণুবিহীন করে তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য।

ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যেই কোরীয় উপসাগর অভিমুখে রণতরী প্রেরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রণতরী বহরে রয়েছে বিমানবাহী জাহাজ এবং কিছু যুদ্ধজাহাজ। প্রশান্ত মহাসাগরে যাত্রা করা বাহিনী সেখানে পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই কাজ করবে। মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড বলেছে, সিঙ্গাপুর থেকে ‘কার্ল ভিনসন’ নামে অ্যাটাক গ্রুপ শনিবার যাত্রা শুরু করেছে। কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা জানিয়ে উত্তর কোরিয়া সতর্ক করে বলেছে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা কেসিএনএ জানায়, এসব যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এটাই প্রমাণ করে, উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণ চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেপরোয়া পদক্ষেপ চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি হলে তাদের জবাব দেয়া হবে।

কেমন হবে কোরীয় যুদ্ধ? পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগ হবে কি? এটা মার্কিন রণবিশারদের জন্য বড় একটি সমস্যা ও বিষয়। ২০১৩ সালে মনে করা হতো উত্তর কোরিয়ার পরমাণু বোমা নেই। কিন্তু এখন তা মনে করা হয় না। এখন উত্তর কোরিয়ার মাঝারি ও দূরপাল্লার পরমাণু অস্ত্র আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে উত্তর কোরিয়া উত্তর আমেরিকায় আঘাত হানতে পারবে। দক্ষিণ কোরিয়াকে আঘাত হানার মতো অস্ত্রসম্ভার তো গড়েই তুলেছে। যদি তেমন কোনো ঘটনা ঘটে, তবে আমেরিকা পরমাণু বোমা ব্যবহার করে উত্তর কোরিয়াকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। উত্তর কোরিয়ার কৌশল হবে হঠাৎ আক্রমণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাংশ, সিউল ও ইনচিয়ান দখল করে নেয়া। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটি ওসান ও কুনসানসহ দক্ষিণ কোরিয়ার আটটি বিমান ঘাঁটি দখল করা উত্তরের প্রাথমিক পরিকল্পনায় রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার রয়েছে ৯৮ হাজার এলিট বাহিনীর একটি সুসজ্জিত ফোর্স। এই ফোর্স এমনভাবে প্রশিক্ষিত যারা এসব বিমান ঘাঁটি দখল বা নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম। এরা যোগাযোগব্যবস্থা ও অস্ত্রের ডিপো অকার্যকর করে দিতেও সক্ষম। উত্তর কোরিয়া এসব ঘাঁটিতে মিসাইল আক্রমণ করতে পারে, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও প্রয়োগ করতে পারে। তবে প্রথম আঘাতেই এসব বিমান ঘাঁটির ক্ষতি করতে না পারলে উত্তর কোরিয়া ভয়ানক অসুবিধায় পড়বে।

উত্তর কোরিয়ার উভচর বাহিনীও আক্রমণে দক্ষতা দেখাতে পারে। উত্তর কোরিয়ার পুরনো ধাঁচের, ৩০০ সোভিয়েত নির্মিত বাইপ্লেন রয়েছে। প্রতিটি যানে ১০ জন কমান্ডো থাকে। এসব যান রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম। কেননা, এগুলো ফাইবার দিয়ে তৈরি। এসবের মাধ্যমে সহজেই আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে আত্মঘাতী হামলা চালানো সম্ভব হবে। উত্তর কোরিয়ার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ওকিনাওয়া ঘাঁটিতে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। জাপানের এ ঘাঁটি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে আমেরিকার থাড অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেম রয়েছে। উত্তর কোরিয়া চাইবে, যেভাবেই হোক এ সিস্টেম অকার্যকর করা।

উত্তর কোরিয়া ইলেকট্রনিক অস্ত্রসম্ভারের প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এসব উচ্চতর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জ্যাম বা নিষ্ক্রিয় করার সক্ষমতা রাখে এবং অনলাইন টার্গেট পরিচালনা ব্যাহত করে দিতে পারে। ইতোমধ্যে উত্তর কোরিয়া অসামরিকীকরণকৃত এলাকার পেছনে বিভিন্ন গুহায় ১৮ হাজার রকেট ব্যাটারি ও দূরপাল্লার তোপ স্থাপন করেছে। তা খুঁজে বের করে ধ্বংস করা কঠিন। এসব পয়েন্ট থেকে অবিরত শত্রু অবস্থানে বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ করা সম্ভব। উত্তর কোরিয়ার ১৭০ এমএম গান এবং ২৪০ এমএম রকেট ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে অবিরত আঘাত হানতে পারে। এতে সিউলের বিরাট এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অসামরিকীকরণ এলাকা বা ডিএমজেডের নিকটবর্তী ১৫০ কিলোমিটার এলাকায় উত্তরের সাত লাখ সেনা প্রস্তুত। আরো উত্তরে রয়েছে অতিরিক্ত চার লাখ সেনা। উত্তর কোরিয়ার আরো রয়েছে ১.৮ মিলিয়ন মিলিশিয়া বাহিনী। যুদ্ধের সময় সবাইকে কাজে লাগানো হবে। এসব সেনা দক্ষিণের সেনার সাথে ম্যাজিওনেট লাইন বরাবর যুদ্ধ করতে পারে। তবে সম্মুখযুদ্ধে উভয় পক্ষে এত অধিক সেনা মোতায়েন করবে বলে মনে হয় না। উত্তরের সেভেন প্যারালাল লাইনে রয়েছে অ্যান্টিট্যাংক ডিভাইস, মাইন ফিল্ড এবং উঁচু পর্বতের ডিপোতে অসংখ্য ট্যাংক।

মনে করা হচ্ছে, আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আকাশপথে বোমা বর্ষণ ছাড়াও উত্তরের বাহিনী দক্ষিণে সিউলের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। ওখানে যেতে উত্তর কোরিয়ার টাস্কফোর্সের মাত্র এক ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে এই এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে, যা কারো হিসাবে হয়তো নেই। যুদ্ধ প্রথম ৩০ মিনিটে উভয় দিকে ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করবে এবং ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হবে। এই আধা ঘণ্টার মধ্যেই কে মূলত জয়ী হবে, তা নির্ধারিত হয়ে যাবে। আমেরিকার আক্রমণও হবে ভয়াবহ। আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান আকাশযুদ্ধে খুব তাড়াতাড়ি শ্রেষ্ঠত্ব লাভে সমর্থ হবে এবং আকাশযুদ্ধে এগিয়ে যাবে। উত্তরের ৭০টি বিমান ঘাঁটিকে কাবু করতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না মর্মে আমেরিকার যুদ্ধ বিশ্লেষকদের অভিমত। আমেরিকার বিমানগুলো উত্তরের কমান্ড ঘাঁটি, যোগাযোগ, রেললাইন, সেতু, ফ্যাক্টরি, গুদাম এসব টার্গেটে ব্যাপক হামলা চালিয়ে প্রথম ঘণ্টায় পিয়ংইয়ংকে অকার্যকর করবে।

১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধে আমেরিকা উত্তর কোরিয়ায় বোমা মেরে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। উত্তর কোরিয়া এ আক্রমণ ভুলতে পারেনি। বোমারুবিমান ও স্টিলথ বম্বার মোতায়েন করায় উত্তর কোরিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বি-২ ভয়াবহভাবে বোমা বর্ষণ করতে সক্ষম। এ বিমান থেকে মোআব ৩০ হাজার পাউন্ড বোমা বর্ষণ করা যায়। মোআবকে ‘সব বোমার মা’ বলা হয়, মাদার অব অল বম্ব। আমেরিকা এরই মধ্যে এই বোমা উত্তর আফগানিস্তানে ফেলেছে। আঘাতে এ পর্যন্ত ৯৮ জন টানেলের ভেতর মৃত্যুবরণ করেছে। মোআব বোমা এমনভাবে তৈরি, যা দিয়ে মাটির নিচের কমান্ড হেডকোয়ার্টার বা বাংকার ধ্বংস করা যায়। এমনকি ভূমির অভ্যন্তরে পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করা যায়। আমেরিকা প্রথম ২০০৩ সালে এই বোমা পরীক্ষা করে। তখন থেকে কোথাও এই বোমা নিক্ষেপ করা হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন বলে আসছেন, সিরিয়ায় টোমাহক ও আফগানিস্তানে মোআব নিক্ষেপ করে উত্তর কোরিয়াকে ‘বার্তা’ প্রদান করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে রাশিয়াও এ রকম এক বোমা বানিয়েছে, যাকে বলা হয় ফোআব, ফাদার অব অল বম্ব যার ক্ষমতা আমেরিকার মোআবের মতো। ৬৫ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া বেশির ভাগ সামরিক স্থাপনা ও ইন্ডাস্ট্রি ভূগর্ভে তৈরি করেছে এবং এসব রক্ষার জন্য ছোট ইউনিট এবং শক্তিশালী যন্ত্রপাতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

আমেরিকা ছোট আকারে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করলে উত্তর কোরিয়াকে পরাজিত করা সহজ হবে না। এমন কাজ করা মানে আমেরিকার পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, যা কেউ সমর্থন করবে না এবং এমন আক্রমণ হলে চীন ও রাশিয়াও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে নেমে পড়তে পারে, যেমনটি হয়েছিল ১৯৫০-এর যুদ্ধে। চীন চাইবে না তার ঘরের দরজায় আমেরিকা পরমাণু যুদ্ধ করুক। তবে চীন অর্থহীন এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে না। পিয়ংইয়ং আরো পরমাণু ও মিসাইল পরীক্ষা চালাতে পারে মনে করছে ট্রাম্প প্রশাসন। আমেরিকার বহরের মধ্যে গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ও গাইডেড মিসাইল ক্রুজার রয়েছে। জাপানি ডেস্ট্রয়ারগুলো এ বহরে যোগ দিয়েছে। পূর্ব চীন সাগরে কারভিনসন অবস্থান নেয়ার সাথে সাথে জাপান অনেক ওয়ারশিপ প্রেরণ করার ঘোষণা দিয়েছে। আমেরিকার নৌবাহিনী সেখান থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান, জাপান সাগরে অবস্থান নেবে এবং কিছু ওয়ারশিপ ইয়েলো সিতে অবস্থান গ্রহণ করবে।

উত্তর কোরিয়া আক্রমণ ও এমন এক পূর্ণ যুদ্ধে তিন লাখ সেনা হতাহত হবে মর্মে হিসাব কষেছে পেন্টাগন। এমন যুদ্ধ অবশ্যই আফগানিস্তান, ইরাক বা সোমালিয়ার যুদ্ধের মতো ‘পুলিশি যুদ্ধ’ হবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার