বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের মাছ ইলিশ। মাছটি সমান জনপ্রিয় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায়ও। জনপ্রিয়তা আছে মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই। যদিও ইলিশের সবচেয়ে বড় আধার বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ফিশ ও বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক ইলিশ আহরণের ৭৫ শতাংশই হয় বাংলাদেশে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ইলিশ আহরণ হয় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরেও দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছে প্রায় চার লাখ টন। আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মাছটির ১৫ শতাংশ আহরণ হয় মিয়ানমারে, ৫ শতাংশ ভারতে ও ৫ শতাংশ অন্যান্য দেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব এলাকার পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ১-২৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানেই আস্তানা গাড়ে রুপালি ইলিশ। এ মাছ সেখানেই ডিম ছাড়ে এবং কয়েক মাস অবস্থান করে। আর ভৌগোলিক কারণে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকূলই ইলিশের প্রজননের জন্য সবচেয়ে আদর্শ স্থান। স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক ইলিশ উৎপাদনের সিংহভাগই হচ্ছে বাংলাদেশে। জাটকা সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা ও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সুরক্ষা কার্যক্রমও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
ইলিশের প্রজনন নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান-বিষয়ক বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ার। সংশ্লিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি মাছের ব্রিডিং জোন পরিবর্তন হতে দেখা যাচ্ছে। সামুদ্রিক এ মাছটি ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আগমন করছে। ব্রিডিংয়ের জন্য ইলিশ আগে দেশের নদীগুলোর উপরের দিককেই বেশি সুবিধাজনক মনে করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হাতিয়া ও সন্দ্বীপ অঞ্চলে ইলিশ মাছ ব্রিডিং করছে। নদীর উপরের দিকগুলো এখন অনিরাপদ হয়ে ওঠার কারণে ব্রিডিং জোন পরিবর্তন করছে। এছাড়া মাছের আকারও পরিবর্তন হচ্ছে। আবাস ও অভয়াশ্রমগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে উৎপাদন কমতে পারে।
জানা গেছে, ইলিশের পঞ্চম অভয়াশ্রম হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার টনের বেশি ইলিশ মাছ উৎপাদন হচ্ছে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকাটিতে। আর এ আন্ধারমানিক নদীটির মোহনার কাছেই নির্মাণ করা হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র। অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে আশুগঞ্জ রুটে চালু হবে বাংলাদেশ-ভারত নৌ-ট্রানজিট। ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ করিডোর)’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েকটি নৌবন্দর নির্মাণসহ বেশকিছু অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে ড্রেজিংও করতে হবে নৌপথটি। আর এ রুটের আশপাশেই রয়েছে ইলিশের অভয়ারণ্য।
মাছের আকার ও ব্রিডিং জোন পরিবর্তন ছাড়াও মাছের অভয়াশ্রমেও পরিবর্তন আসছে। যদিও ইলিশের আহরণ বাড়াতে তিন বছর গবেষণার পর বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন ৬০ কিলোমিটার এলাকা ষষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণার জন্য ২০১৩ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। সংস্থাটির ‘আন্ডারস্ট্যাডিং ফিশারি কনফ্লিক্টস ইন হিলশা স্যাঙ্কচুয়ারিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, শরীয়তপুর জেলার বাংলাবাজার এলাকায় ও বরিশাল জেলার পুরাতন হিজলা এলাকায় অভয়াশ্রমের মতোই রেণু উৎপাদন হচ্ছে। এ দুটি অঞ্চল পূর্বঘোষিত পদ্মা ও মেঘনা এলাকার অভয়াশ্রমের পাশেই অবস্থিত। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হলে এ দুটি স্থানও অভয়াশ্রম করার সময় এসেছে। আর এসব স্থান ও পয়েন্টগুলোকে আরো বেশি সুরক্ষা দেয়া গেলে মাছের উৎপাদন সহজেই বাড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. লিয়াকত আলী বলেন, ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রজনন পয়েন্ট ও অভয়ারণ্য এলাকা প্রয়োজনে বাড়াতে হবে। এজন্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। নতুন ও পুরনো অভয়াশ্রম ও প্রজনন পয়েন্টগুলোর সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জেলে, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, কোস্টগার্ডের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জেলেদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো ও বিকল্প কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। তাহলে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হার আরো বাড়ানো সম্ভব হবে।
বিএফআরআইয়ের ‘জাটকা ও ইলিশের প্রাচুর্য ও বিচরণক্ষেত্র রক্ষা এবং জেলেদের বিকল্প আয়ের উপায় নির্ধারণ’-বিষয়ক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ পিস মা মাছ ধরা হয়। প্রতি বছর দেশের নদীগুলো থেকে প্রায় ৩৮ কোটি জাটকা মাছ ধরা হয়। এসব মাছ অসময়ে না ধরে স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ দিলে ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং গবেষণা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবিএম জাহিদ হাবিব বলেন, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও মা ইলিশ নিধনরোধের লক্ষ্যে নদ-নদীর জাটকাপ্রধান অঞ্চলে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের সময়সীমা ছিল ২২ দিন। এখন তা বাড়িয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে। সরকার নদ-নদীর জাটকাপ্রধান অঞ্চলে পাঁচটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পর প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে ও জেলেদের মধ্যে সচেতনতা আনতে প্রধান এ প্রজনন মৌসুমে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান’-এর লক্ষ্যে প্রায় সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাসহ ২৭ জেলার ইলিশ প্রজননক্ষেত্রে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার মদনপুর বা চরইলিশা থেকে চরপিয়াল পর্যন্ত শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এবং শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া-ভেদরগঞ্জ উপজেলা অংশে নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ইলিশের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সীমানা হচ্ছে— মীরসরাই উপজেলার শাহের খালী থেকে হাইতকান্দী পয়েন্ট; তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট; কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপালি পয়েন্ট ও কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবদিয়া থেকে গ্লারমারা পয়েন্ট।
এ বিষয়ে বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহের বলেন, ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে আইনগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেমন নিতে হবে, তেমনই জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এসব জেলের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আরো সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জাটকা নিধন প্রতিরোধ এবং মা মাছ রক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে।