আর্থিক সংকটে জর্জরিত দেউ শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন কোম্পানিকে বাঁচাতে নতুন করে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। দেউ’র দুই শেয়ারহোল্ডার কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (কেডিবি) ও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া এ অর্থ দিয়েছে।
কার্যাদেশের বিচারে দেউ হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম শিপইয়ার্ড। একসময় এটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কনগ্লোমারেট দেউ গ্রুপের অংশ। নব্বইয়ের দশকে দেউ গ্রুপের পতন হলেও জাহাজ নির্মাণ ব্যবসাটি টিকে যায়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে নৌ-পরিবহন খাতের মন্দা, জাহাজের সংখ্যাধিক্য ও চীনা জাহাজ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতার চাপে দেউ শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন কোম্পানির এখন নাজেহাল অবস্থা।
দেউ শিপবিল্ডিংয়ের সিংহভাগ মালিকানা এখন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাতে। ২০১৫ সালে শেয়ারহোল্ডাররা ডেইয়ুকে ৩৮০ কোটি ডলার ঋণ দেয়।
গত বছর দেউ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার লোকসান গুনেছে। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ এখন পুঁজির ২৭ গুণে দাঁড়িয়েছে। দেউ’র বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ও ঋণদাতা কেডিবি এবং আরেক শেয়ারহোল্ডার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া সর্বশেষ যে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, তার সঙ্গেও অন্য ঋণ জুড়ে রয়েছে। দেউ’র অন্য ঋণদাতা ও বন্ডহোল্ডাররা আরো প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার জোগাতে সম্মত হওয়াতেই কেডিবি ও এক্সিম ব্যাংক এবারের ঋণ দিয়েছে।
এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেউকে নতুন তহবিল সঞ্চার না করার ঘোষণা দিয়েছিল।
এবারের দেউ উদ্ধার পরিকল্পনার বিষয়ে কেডিবি সিইও লি দং-গিওল বলেন, জাহাজ নির্মাণ খাতের দীর্ঘকালীন মন্দার মাত্রা নিরূপণে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। দেউ’র ঝুঁকিগুলোও বুঝতে পারিনি।
কেডিবি সিইও লি দং-গিওল সাংবাদিকদের বলেন, দেউ আর্থিকভাবে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পতিত হয়েছিল। জোরালো ও সর্বাত্মক উদ্যোগ না নিলে এপ্রিলে বড় অংকের করপোরেট বন্ডের মূল্য পরিশোধের সময় দেউ অসচ্ছলতার মুখোমুখি হবে।
দেউতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ কর্মরত। হংগিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অর্থনীতিবিদ চুন সুং-ইন কোম্পানিটির বিষয়ে ‘অসামঞ্জস্য, দীর্ঘসূত্রী ও অন্যায্য’ অবস্থান নেয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন।
অর্থনীতিবিদ চুন সুং-ইন বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে বড় ধরনের করপোরেট পুনর্গঠনের সুযোগ হারিয়েছে। এ কারণে সরকার দেউতে অতিরিক্ত তহবিল সঞ্চারে বাধ্য হয়েছে।
২০১৮ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইয়নহাপ সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া সরকার আগামী বছর নাগাদ ‘স্লিম ও পুনর্জন্মপ্রাপ্ত’ দেউ’র বিক্রির আশা করছে।
দেউ শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন কোম্পানি, হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ— জাহাজ নির্মাণ খাতের এ তিন অতিকায় কোম্পানি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিগ থ্রি নামে পরিচিত। একসময় কোম্পানি তিনটি দক্ষিণ কোরিয়ার করপোরেট মুকুটের শোভা বলে বিবেচিত হতো।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিগ্র থ্রি আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাদের ইউরোপীয় ও জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে বাধ্য করে। বৈশ্বিক জাহাজ নির্মাণ বাজারের ৭০ শতাংশই তখন কোরীয় কোম্পানিগুলোর করায়ত্ত ছিল। নৌ পরিবহন ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোকে বছরের পর বছর বড় কার্গো জাহাজ, ট্যাংকার ও সাগরে খননের রিগ সরবরাহ করেছে বিগ থ্রি।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় ট্যাংকার ও কার্গো জাহাজের চাহিদা কমেছে। নৌ-পরিবহন খাতের অতি সক্ষমতা, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও কম খরচে জাহাজ নির্মাণকারী চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা মুনাফাও সংকুচিত করেছে।
২০১৫ সালে বিগ থ্রি মোট ৭৪০ কোটি ডলার লোকসান গুনেছে।
ব্যাংক ঋণ সংগ্রহ করতে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ডেইয়ু শিপবিল্ডিংয়ের হিসাব কারসাজি করায় কোম্পানির সাবেক প্রধান কো জায়ে-হো জানুয়ারি মাসে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।