Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শুধু এশিয়া নয়, সারাবিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া নেতৃস্থানীয়। সেরা শিক্ষাব্যবস্থার র‍্যাংকিংগুলোতে সেরা পাঁচে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান এখন নিয়মিত ব্যাপার। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কিংবা সাহিত্য সবক্ষেত্রে কোরিয়ানদের অগ্রগতি ছিলো অনেকটাই মিরাকল। মিরাকলের পিছনে যার বিশেষ ভূমিকা তা হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফে নিয়মিত লিখছেন রিদওয়ানুল মসরুর। আজ প্রকাশিত হলো তার  চতুর্থ পর্ব।

১৯৫০ সালের একটি প্রাইমারী স্কুল

১৯৫১ পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ  

chardike-ad

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার ইতিহাসে ১৯৫০ এর দশক সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এসময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণে যেন বিস্ফোরণ ঘটে। হু হু করে বেড়ে চলে বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই দশকের ক্যারিশমাতেই এক সময়ের ৫% সাক্ষরতা হারের দক্ষিণ কোরিয়া আজ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উচ্চশিক্ষিত জাতি। ১৯৫০ এর দশকে কোরিয়াতে প্রতি বিশ জনে একজন পড়ালেখা জানতো; না ছিলো প্রশিক্ষিত শিক্ষক, না ছিলো কোন শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অথচ আজকের কোরিয়া কেবল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত জাতিই নয় বরং উচ্চ প্রশিক্ষিত শিক্ষক, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিক্ষা গবেষণা ও তার বাস্তবায়নের হার, উচ্চ শিক্ষায় সর্বাধিক মানুষের অংশগ্রহণ ইত্যাদি সব দিক দিয়েই বিশ্বে সুপরিচিত ও এগিয়ে। যদিও পঞ্চাশের দশকের কোরিয়ান যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শিক্ষার উন্নয়নের পথকে কণ্টকময় করে তুলেছিলো, তবুও শিক্ষার উন্নয়নের পথচলায় কোন ভাটা পড়েনি। আর এই সাফল্যের গল্পের নায়ক ছিলো কোরিয়ান বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। যাঁরা স্বল্প বেতনে, খেয়ে না খেয়ে নিয়মিত ঘি ঢেলেছেন উন্নয়নের আগুণধরা জোয়ারে।

দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনা দারুণ নিয়ম নির্ভর। উন্নয়নের পরিকল্পনা তাই গাণিতিক ধারার মতই। একটার পর আরেকটা ক্ষেত্র ধরে ধরে তার উৎকর্ষতা সাধন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনার শুরুটা তাই প্রাথমিক শিক্ষা কে ঘিরে। শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং সে সার্বজনীনতা কেবল প্রবেশাধিকারে নয়, বরং শিক্ষার গুণগতমান ও বিষয়বস্তু এর ক্ষেত্রেও সার্বজনীনতা নিশ্চিতকরণ। ধাপে ধাপে উন্নয়নের পরিকল্পনার প্রকাশ সর্বপ্রথম দেখা যায় ১৯৪৮ সালে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সরকার এর পরিকল্পনা ছিলো সর্বস্তরের শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন কিন্তু রি (Rhee) প্রশাসন (১৯৪৮-১৯৬০) এর পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও বিকাশ। সে উপলক্ষে কোরিয়ান ন্যাশনাল এসেম্বলিতে পাশ হওয়া কোরিয়ান সংবিধানের ১৬ ধারায় প্রাথমিক শিক্ষা কে সার্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ হয় সব ধরণের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকার দেশের সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব নেয়। ১৯৪৯ সালে রি প্রশাসনের নেওয়া প্রথম ছয় বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনায় সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে এক উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। সে কর্মসূচি অনুযায়ী প্রচুর শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়, নিয়োগ করা প্রচুর শিক্ষক এবং ব্যবস্থা করা হয় তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের। একই সাথে চলে উপযুক্ত বয়সি সকল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার ক্যাম্পেইন। ১৯৫৬ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় গমনোপোযোগী শিশুদের শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষার আওতায় আসার পূর্বপর্যন্ত চালু থাকে এই কর্মসূচি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৪৯ এ শুরু হওয়া এই কর্মসূচি কোরিয়ান যুদ্ধের (১৯৫০ থেকে ১৯৫৩) মত দুঃসময়েও চালু ছিলো এবং কোরিয়ান জাতি কতটা নিষ্ঠা, ত্যাগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তা চালু রেখেছিলো যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে (যখন কিনা প্রকৃত অর্থেই পুরো জাতি ক্ষুধা, ধ্বংস, দারিদ্র, হতাশা আর রোগে-শোকে মৃতপ্রায় ছিলো) তা এককথায় অকল্পনীয়।

১৯৫২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোরিয়ায় একটি স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা
১৯৫২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোরিয়ায় একটি স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা

সীমিত সম্পদ, দক্ষ ও যোগ্য লোকবলের অভাব, ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণে জর্জরিত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কোরিয়ান যুদ্ধে ধ্বংসপ্রায় অবকাঠামো ও অর্থনীতির দেশে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে সরকার দারুণ সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রথমত, জাপানি উপনিবেশ আমলের বিদ্যমান জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের মার্কিন প্রগতিবাদী শিক্ষার কোনটার সাথেই আপোষ না করে, হারিয়ে ফেলা কোরিয়ান শিক্ষার ঐতিহ্য কে সামনে রেখে শিক্ষা পরিকল্পনা করা হয়। ফিরে আসে কনফুসিয়ান দর্শন – তার মিশেল ঘটে মার্কিন প্রগতিবাদী শিক্ষা দর্শন এবং জাপানি শিল্পমূখী শিক্ষাধারার সাথে।

দ্বিতীয়ত, একদিকে দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং অন্যদিকে প্রয়োজনীয় বিদ্যালয় অবকাঠামো তথা শ্রেণিকক্ষের অভাব। এই দ্বিমূখী সংকট সামাল দিতে শ্রেণির আকার বাড়ানো হয়। প্রতিটি শ্রেণিতে শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে যতটা স্থান পাওয়া যায়, ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয় শ্রেণিকক্ষ হিসেবে। এতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিদ্যালয় চলে দু-তিন শিফটে। কাকডাকা ভোরে শুরু হওয়া বিদ্যালয় দু-তিন শিফট চলে বন্ধ হতো প্রায় মধ্যরাতে।

তৃতীয়ত, বেসরকারি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ায় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা থাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু, শিক্ষায় অর্থায়ন দারুণ এক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। শিক্ষকদের বেতন দেওয়া, বিদ্যালয় অবকাঠামো নির্মাণ, পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে সরকার। এ সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেন অভিভাবকগণ; যে যার সাধ্য অনুযায়ী সবটুকু সাহায্য করেন – নিশ্চিত করেন সন্তানদের সুশিক্ষা। কেবল শহরাঞ্চলেই নয়, প্রত্যন্ত এলাকার অভিভাবকারাও এগিয়ে আসেন নানা সাহায্য নিয়ে।

১৯৭১ সালে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

চতুর্থত, শিক্ষা বিপ্লবের সেই প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারকে একনিষ্ঠভাবে সাহায্য করে কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এবং ইউএন কোরিয়া রিকনস্ট্রাকশন এজেন্সি। সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাশ্রম দিতে – গড়ে তুলেন জাতীয় জনমত। শিক্ষা পিপাসু জাতির জন্য তা বয়ে আনে দারুণ এক আশীর্বাদ।

যদিও কোরিয়ান যুদ্ধের সময় ব্যাঘাত ঘটে শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনায়, তথাপিও যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পুরো জাতি লেগে পড়ে সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ অভিযানে। ১৯৫৩ তে সে ছয় বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা পরিমার্জন করা হয়। ১৯৫৪ তে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার দাঁড়ায় ৮৮%, ১৯৫৫ সালে তে বেড়ে দাঁড়ায় ৯১% এবং ১৯৫৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬.৪%। নিচের টেবিলে সময়ের পরিক্রমায় দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে ভর্তির হার তুলে ধরা হলো –

table south korea
সময়ের পরিক্রমায় দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে ভর্তির হার

কোরিয়ার প্রথম ও দ্বিতীয় ছয়-বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার সময়ে সরকারের শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রায় সবটুকু জুড়েই ছিলো প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ ও গুণগত মানের উন্নয়ন। ফলে সে সময়ে মাধ্যমিক (নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক) ও উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে প্রচুর বেসরকারি অর্থায়ন ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকা দারুণ ভাবে প্রশংসিত হয় পরবর্তী সময়ে। কোরিয়ান শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে, বিশেষত মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও বিকাশে দেশের বৃহৎ শিল্প নির্ভর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহের (যেমন- স্যামসাং, হুন্দাই) অবদান অপরিসীম। একই সাথে এসকল শিল্প নির্ভর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রচুর টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। যদিও সেসকল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিলো তাদের শিল্প কারখানাসমূহে দক্ষ জনশক্তির জোগান নিশ্চিত করা, তথাপিও আধুনিক কোরিয়া বিনির্মাণে এই উদ্যোগের অবদান অপরিসীম।

রি প্রশাসনের সময়েই সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য সন্তোষজনকভাবে অর্জিত হয়। পরবর্তীতে পার্ক প্রশাসন, যাকে আধুনিক কোরিয়ার রূপকার হিসেবে চেনে বিশ্ব, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণে মনোযোগী হয়। ছয় বছরের সার্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যার্জন শেষে নয় বছর পর্যন্ত (প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক) শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৬১ সালে। সেই লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা অন্তত চারগুণ বৃদ্ধি পায়, শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৯০ শতাংশ (সাধারণ ও ভোকেশনাল বিদ্যালয় সম্মিলিত)।

১৯৮১ সালে
১৯৮১ সালে ইয়নসে ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একাংশ

আশির দশকে দেশে উচ্চ শিক্ষার বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হয় এবং বেসরকারি উদ্যোগে মাশরুমের মত গজিয়ে ওঠে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রতি পাঁচজনে দুজন কোরিয়ান ভর্তি হয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একই সাথে প্রচুর উচ্চ শিক্ষিত কোরিয়ান পাড়ি জমাতে শুরু করে বিদেশে – বাড়তি উচ্চশিক্ষা অর্জনে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে এঁদের বেশিরভাগই ফিরে এসে নিজেদের নিয়োজিত করে দেশ গঠনে এবং সরকার তাঁদেরকে দারুণভাবে স্বাগত জানায়। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণে কোরিয়ানদের প্রবল আগ্রহ আর বিপুল প্রচেষ্টা জন্ম দেয় আজকের সুপরিচিত শব্দ ‘কোরিয়ান শিক্ষাজ্বর (কোরিয়ান এডুকেশন ফিভার)’ এর।

এ তো গেলো শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ আর সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনার গল্প। দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার উন্নয়নের আসল অলৌকিকতা নিহিত রয়েছে একই সাথে শিক্ষার সম্প্রসারণ আর গুণগত মানোন্নয়নের সফলতায়। আর তার পটভূমিতে রয়েছে শিক্ষক শিক্ষার উন্নয়ন ও ব্যাপক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। জাপানি শাসনামলে কোরিয়ায় বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন জাপানি। উপনিবেশের অবসান ঘটায় জাপানিরা কোরিয়া ত্যাগ করার ফলে এবং কোরিয়ান যুদ্ধের কারণে যুদ্ধ পরবর্তী কোরিয়ায় প্রশিক্ষিত তো দূরে থাক, যথাযথভাবে শিক্ষিত শিক্ষকের অভাব ছিলো প্রকট। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র ১.৫% এর কলেজ পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা ছিলো, ০.১% প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ছিলো উচ্চশিক্ষা। ফলশ্রুতিতে নবগঠিত সরকার ইউনেস্কো, ইউএন কোরিয়া রিকনস্ট্রাকশন এজেন্সি ও মার্কিন সরকারের সহায়তায় দেশব্যাপী ব্যাপক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়। সে কর্মসূচির আওতায় কেবল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে কর্মরত ষাট হাজার শিক্ষকের মধ্যে সাড়ে আঠারো হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়। ১৯৫৫ তে এসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সকল গ্রাজুয়েট কে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একদিকে যেমন ব্যাপক শিক্ষক উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়, তেমনি অন্যদিকে ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে প্রবেশের যোগ্যতা। তারই ফল দেখা যায় সর্বপেরি শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমউন্নয়নে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার মেয়াদ
দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার মেয়াদ

তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিলো শিক্ষার্থীদের জন্য স্থান সংকুলান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়া তখন বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি। সে সময়ের স্বল্প শিক্ষা বাজেটের শতকরা ষাট থেকে আশিভাগই যেত শিক্ষকদের বেতন ও প্রশিক্ষণে। ওদিকে নিয়মিত হারে বেড়ে চলেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কোরিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে মোট শ্রেণিকক্ষ ছিলো কম বেশি ২৮ হাজার যা ন্যূনতম এর চেয়েও অনেক অনেক কম। ফলশ্রুতিতে শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে শ্রেণি পরিচালনার পরও একাধিক শিফটের ব্যবস্থা করতে হতো। শ্রেণি কক্ষের আসবাব, শিখন-শেখানো উপকরণের প্রকট অভাবের কথা আর না ই বা বললাম। এর ওপর ছিলো দেশব্যাপী দুর্নীতি আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জয়জয়কার। সেদিনের সেই কঠিন অবস্থা থেকে মাত্র বিশ-ত্রিশ বছরে যা অর্জন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া, তা সারা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য দারুণ এক দৃষ্টান্ত।

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার এই বিস্ময়কর বিকাশে সরকারি উদ্যোগ, উন্নয়ন পরিকল্পনা কিংবা শিক্ষানীতি যতটা না প্রশংসিত হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রশংসার দাবি রাখে অভিভাবকদের সন্তানের শিক্ষার জন্য একরোখা প্রচেষ্টা ও পূঁজি বিনিয়োগ এবং কোরিয়ার অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকগণ। সত্যিকথা বলতে কি এদেশের শিক্ষকরাই জন্ম দিয়েছে আধুনিক কোরিয়ার এবং ষাট-সত্তর-আশির দশকের কোরিয়ান শিক্ষকদের সম্মিলিত ত্যাগ আর খেয়ে না খেয়ে অতি অল্প কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে বিনাবেতনে রাত্রিদিন খেটে যাওয়ার গল্প আজ সমগ্র বিশ্বে শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মুখে মুখে ঘোরে গর্বের মুকুট হয়ে – রূপকথার মত করে আমরা বলি সেই দীর্ঘমেয়াদী বীরত্বগাঁথা।

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা এর অন্যান্য পর্ব:
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (প্রথম পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (দ্বিতীয় পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (তৃতীয় পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (শেষ পর্ব)

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা নিয়ে লেখার  শেষ পর্বে উপস্থাপিত হবে ‘দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার ক্রম পরিবর্তন ও সামাজিক উন্নয়ন’ – কিভাবে দক্ষিণ কোরিয়া উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রকৌশলবিদ্যার মত ব্যবহার করেছে জাতি ও দেশ গঠনে।

redowan