চীনের বিরুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ দায়েরের কথা ভাবছে দক্ষিণ কোরিয়া। ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েনের জের ধরে বেইজিং বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা আরোপ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল চীনের বিরুদ্ধে করণীয় নির্ধারণে ১৩টি ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। খবর রয়টার্স।
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র কোরীয় ভূখণ্ডে টার্মিনাল হাই অল্টিচিউড এরিয়া ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শুরু করছে। এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি গতকাল থেকে কোরিয়ায় পৌঁছাতে শুরু করেছে।
চীন এ খবরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, বেইজিং এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের তীব্র বিরোধিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে এর পরিণাম ভোগ করতে হবে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেছেন, নিজের নিরাপত্তা সমুন্নত রাখতে চীন অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এর জের ধরে যা কিছু হবে, সবকিছুর দায়ভার যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বইতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতাসীন লিবার্টি কোরিয়া পার্টি বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েনের জের ধরে চীন বিভিন্ন বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আরোপ করছে। এ ব্যাপারে ডব্লিউটিওতে অভিযোগ দায়েরের কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চীনে ব্যবসারত দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে সাইবার হামলা, সনদ বাতিল, জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ তুলেছে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রচারমাধ্যম কোরীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
লিবার্টি কোরিয়া পার্টির পলিসি কমিটির চেয়ারম্যান লি হিউন-জায়ে গতকাল দক্ষিণ কোরিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় তিনি বলেন, চীনের পদক্ষেপগুলো দক্ষিণ কোরিয়া-চীন বাণিজ্য চুক্তির পরিপন্থী কিনা আমরা তা সক্রিয়ভাবে ভেবে দেখব। একই সময় আমরা দক্ষিণ কোরীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এসব পদক্ষেপের প্রভাব কমাতে চাইব।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং দক্ষিণ কোরিয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আইন মেনে ব্যবসা করতে আসা বিদেশী কোম্পানিগুলোকে চীন সবসময় স্বাগত জানাবে ও সুরক্ষা দেবে।
ইয়োনহাপ বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, কোরীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চীনের সম্ভাব্য বৈষম্যের সবশেষ উদাহরণ জেজু এয়ার। প্রতিষ্ঠানটি দুদেশের মধ্যে চার্টার ফ্লাইট চালুর আবেদন জানিয়ে বেইজিংয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
এর আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম দুটি আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এসব প্রত্যাখ্যানের পেছনে চীন কোনো কারণ উল্লেখ করেনি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, তিনি কোনো চার্টার ফ্লাইট ইস্যু সম্পর্কে অবহিত নন।
চীন সরকার গত সপ্তাহে সে দেশের ট্যুর অপারেটরদের দক্ষিণ কোরিয়াগামী প্যাকেজ বিক্রি বন্ধ করতে বলেছে। এ কারণে স্থানীয় পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার সাড়ে ৪ কোটি ডলার (৫০ বিলিয়ন ওন) ‘বিশেষ ঋণ’ ঘোষণা করেছে।
কোরীয় রিটেইলার লোটে মার্টের মুখপাত্র গতকাল বলেছেন, চীনা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পরিদর্শনের জের ধরে ৩৯টি স্টোর বন্ধের আদেশ দিয়েছে। এর মধ্যে একটি স্টোরকে জরিমানা করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সহকারী বাণিজ্যমন্ত্রী উ তায়ে-হি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া চীনের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে ডব্লিউটিও অথবা দ্বিপক্ষীয় ফোরামে আলোচনা করতে চায়। দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্যকে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হতে হবে— সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কিছু পদক্ষেপ এ ধারণার পরিপন্থী।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নিজেকে মুক্ত বাণিজ্যের প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিশেষত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতারোহণের পর তিনি মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার পক্ষে বিভিন্ন ফোরামে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনকে ঘিরে চীনের পদক্ষেপগুলো শি জিনপিংয়ের এসব বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের পর শি জিনপিং চীনের নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক প্যাক্ট (আরসিইপি) এগিয়ে নিতে চাইছেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে তিনি ১৬-জাতি ফোরামটিতে যোগদানে আগ্রহী করতে চাইছেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আরোপের অভিযোগ চীনের আরসিইপি উদ্যোগকে পিছিয়ে দিতে পারে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানুয়ারি মাসে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে বক্তব্য রাখেন। সেখানে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্দেশে বাণিজ্যযুদ্ধ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংরক্ষণবাদ হলো নিজেকে বদ্ধ ঘরে আটকে রাখার মতো। যেকোনো বাণিজ্যযুদ্ধ উভয় পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৪ সালে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা চূড়ান্ত করে। ২০১৫ সালে দুদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হয়। ২০১৪ সালে অ্যাপেক সম্মেলনের পাশাপাশি এক আলোচনায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া ভালো প্রতিবেশী ও অংশীদার হিসেবে পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে।’
শি জিনপিংয়ের ওই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের এখনই সময়।