বিদেশে কর্মরতরা তাদের অর্জিত যে অর্থ দেশে প্রেরণ করে, তাকে আমরা রেমিট্যান্স বলি। এটি আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম উত্স। জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এই রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একই সঙ্গে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই রেমিট্যান্স হচ্ছে এ দেশের অর্থনীতির প্রধান প্রাণশক্তি এবং একই সঙ্গে চালিকাশক্তি। এই রেমিট্যান্সই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান অংশ। আমদানির বিপরীতে বৈদেশিক দেনা পরিশোধে রেমিট্যান্স প্রধান ভূমিকা পালন করে। বিদেশে কর্মরত এ দেশের লাখো মানুষের ঘাম ঝরানো কষ্টে অর্জিত অর্থ এ দেশকে বছরের পর বছর ধরে উন্নত করে চলেছে। তাদের পাঠানো অর্থে সচল আমাদের অর্থনীতির চাকা এবং সচল আমাদের জীবন। বিদেশে কর্মরত এসব মানুষের অর্জিত অর্থ তাদের পরিবারের লোকজনের জীবনকে যেমন করেছে দরিদ্রতামুক্ত এবং সচ্ছল, ঠিক তেমনি এ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থানকে করেছে উন্নত। যেই মানুষটি একসময় দেশে বেকার অবস্থায় দিন কাটিয়ে পরিবার এবং রাষ্ট্রের দায় হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই মানুষটিই আজ বিদেশে গিয়ে পরিবার এবং রাষ্ট্রের জন্য আনছে বৈদেশিক মুদ্রা। তিনি আজ পরিবার এবং রাষ্ট্র উভয়েরই সম্পদ। বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিটির পাঠানো অর্থে তাদের ছেলেমেয়েরা আজ ভালো স্কুলে পড়াশোনা করছে, উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। তিনি গ্রামে বা শহরে পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন, তার পরিবারের লোকজন উন্নত জীবন যাপন করছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করছে। শহর তো বটেই, গ্রামবাংলার জীবনযাত্রায় আজ যে উন্নয়ন, তা বিদেশে কর্মরত এসব মানুষের পাঠানো অর্থেরই প্রতিফলন। সুতরাং এ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অপরিহার্য। আর তাই রেমিট্যান্স বাড়াতে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০১৫ সালে ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে রেমিট্যান্স কম এসেছে এবং এটির পরিমাণ ১৭১ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে এটি বিগত বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ১৬ কম। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১ হাজার ৪১৭ কোটি, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৩৮৩ কোটি, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৪৯২ কোটি, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৫৩২ কোটি ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এখানে মূলত ব্যাংকিং চ্যানেল অর্থাত্ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স এসেছে, তার হিসাব। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও বিশাল অংকের রেমিট্যান্স আসে। আর এটি এই হিসাবের বাইরে। সুতরাং হুন্ডির মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স প্রেরিত হয়, তা হিসাব করা হলে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো বেশি হবে। হুন্ডির কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে কিনা, সে বিষয় তদন্ত করে দেখতে হবে। বিদেশে কর্মরতরা তাদের অর্জিত অর্থ যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন, সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং একই সঙ্গে প্রবাসীরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে সহজে অর্থ পাঠাতে পারেন, সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে এবং বিদেশে অনেক এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য চুক্তি করেছে। রেমিট্যান্স প্রেরণের জন্য বিশ্বে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংকও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ রেমিট্যান্স সংগ্রহকারীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে। তবে এ ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা আরো বাড়াতে হবে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনার আলোকে এ সেক্টরকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। আরো বেশি বাংলাদেশী যেন চাকরি নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেতে পারে, তার জন্য সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশী কর্মরত। আশির দশকের শুরুতে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় জনশক্তি রফতানি শুরু হলেও বর্তমানে তা ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশের মানুষ কাজ করছে এবং এটি এখন বিশাল একটি থ্রাস্ট সেক্টরে পরিণত হয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১৩৬১ কোটি ডলার মূল্যের রেমিট্যান্স এসেছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড একাই সংগ্রহ করেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বার্ষিক অবদান শীর্ষে এবং অংশীদারিত্ব ২৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। দেশের সব ব্যাংক যদি রেমিট্যান্স আরহণের জন্য আরো তত্পর হয়, তাহলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো বাড়বে। কারণ তখন হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ কমে আসবে। রেমিট্যান্স তখন জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।
বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ এবং তাদের সমস্যা-সম্ভাবনাকে দেখভাল করার জন্য সরকারের জনশক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রয়েছে। এদের কাজ হবে, বিশ্বের কোন কোন দেশের কোন কোন খাতে কোন সময়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তার আপটুডেট খবর নিতে হবে এবং তা জনগণকে জানাতে হবে। সেখানে যাতে বাংলাদেশী লোকেরা চাকরি নিয়ে যেতে পারে, তার উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লোকজনকে দক্ষ করে তোলার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশী লোকজন যাতে সহজে ভিসা পায় এবং কম খরচে বিদেশে যেতে পারে, সে বিষয়ে সরকারের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি লোকটি বিদেশে গিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত চাকরিতে যোগদান করতে পারে, সে বিষয়ও সরকারকে তদারক করতে হবে। বিদেশ যেতে এবং বিদেশে গিয়ে সে যাতে কোনো বিপদের সম্মুখীন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিটির সুখ-দুঃখে যেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা পাশে থাকেন, সে বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। মানব পাচারকারী এবং দালালের খপ্পরে পড়ে কোনো মানুষের জীবন যাতে কষ্টে পতিত না হয়, সেই বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য মানব পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে জনগণ যাতে দালালদের খপ্পরে না পড়ে, তার জন্য জনগণকে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। অথচ এর জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। এই জনগণকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। ঘনত্বের দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবসতির দেশ। এখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বেকার। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই লোকজন কর্মসংস্থানের জন্য ছুটছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কর্মসংস্থান দিন দিন বাড়ছে। আর এই কর্মসংস্থান পূরণের মতো জনবল পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং অধিক সন্তান নিতে নারীদের অনীহার কারণে ইউরোপের অনেক দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার যুদ্ধবিগ্রহের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বেকার যুবকদের বিদেশে পাঠানোর বিরাট সুযোগ রয়েছে। এজন্য সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। এদিকে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে অনেক যুবক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিদেশে যেতে পারছে না। এমনকি অনেকে বিমান ভাড়ার টাকাটিও জোগাড় করতে পারে না। সরকার যদি বিদেশে যাওয়ার জন্য একটি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে সেই অর্থ দিয়ে একজন ব্যক্তি বিদেশ যাবে এবং পরবর্তীতে বিদেশে গিয়ে অর্থ আয় করে সেই ঋণ পরিশোধ করবে। বিদেশ গমনকারী ব্যক্তিটির দেশে অবস্থানরত নিকট আত্মীয়স্বজন এই ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টর হবে। সরকার অতি সহজেই এজন্য একটি স্কিম ঘোষণা করতে পারে। সরকার ইচ্ছা করলেই এই খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকও বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। বর্তমানে এ দেশের অনেক ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতির কাছে ব্যাংকগুলোর অনেক টাকা পাওনা আছে এবং শুধু খেলাপি ঋণের পরিমাণই ১ লাখ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এই টাকা বছরের পর বছর ধরেই অনাদায়ী। অথচ বিদেশে যাওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো অতি সহজেই ব্যক্তিপ্রতি ২ লাখ টাকা করে ঋণ দিতে পারে।
জালাল উদ্দিন ওমর : প্রকৌশলী ও উন্নয়নকর্মী
বণিকবার্তার সৌজন্যে।