শুধু এশিয়া নয়, সারাবিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া নেতৃস্থানীয়। সেরা শিক্ষাব্যবস্থার র্যাংকিংগুলোতে সেরা পাঁচে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান এখন নিয়মিত ব্যাপার। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কিংবা সাহিত্য সবক্ষেত্রে কোরিয়ানদের অগ্রগতি ছিলো অনেকটাই মিরাকল। মিরাকলের পিছনে যার বিশেষ ভূমিকা তা হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফে নিয়মিত লিখছেন রিদওয়ানুল মসরুর। আজ প্রকাশিত হলো তার দ্বিতীয় পর্ব।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে উনবিংশ শতাব্দী
প্রথম পর্বে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমসাময়িক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু দারুণ এই শিক্ষা ব্যবস্থা একদিনে এপর্যায়ে আসে নি; বরং এর পেছনে রয়েছে ঘটনাবহুল ক্রমপরিবর্তন ও উন্নয়নের ইতিহাস। সে নিয়ে কথা হবে এ পর্বে ও পরের (তৃতীয়) পর্বে।
কোরিয়ায় শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরোনো। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সমাজে শিক্ষা দারুণভাবে মূল্যায়িত হয়ে এসেছে। তবে আধুনিক কোরিয়ার শিক্ষার বিকাশ মূলত শুরু হয় ‘কোরিয়ার তিন রাজ্য’ (삼국시대) এর সময় থেকে।
৫৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোরিয়ান অববাহিকা প্রধান তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এই তিনটি রাজ্য ছিলো বেকজে, শিল্লা এবং খোগোরিও। এই খোগোরিও নাম থেকেই পরবর্তী সময়ে কোরিয়া নামের উদ্ভব।
প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কোরিয়ার শিক্ষা ছিলো শিকার, মাছধরা, বিভিন্ন দৈনন্দিন যন্ত্রপাতি ও যুদ্ধকে ঘিরে। পরবর্তীতে ধর্ম ও ধর্মীয় বিষয়াদি, লেখার পদ্ধতি, হিসেব ইত্যাদি শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। খোজোসন কাল (১০৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এর পূর্ববর্তী সময়; কোরিয়ান ভাষায় ‘খো’ মানে পূর্ববর্তী খোজোসন এর অর্থ হলো জোসন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বের সময়) এর শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক বিষয়াদি লিপিবদ্ধ আছে বিখ্যাত ‘সামগুক ইয়োসা’ ও অন্যান্য প্রাচীন কোরিয়ান বই ও রচনা সমূহে। কোরিয়ার প্রথম শিক্ষা বিষয়ক শ্লোগান ছিলো ‘হোঙ্গিক ইনগান’ (홍익인간; 弘益人間) যার অর্থ হলো ‘মানবজাতির মঙ্গলের জন্য জীবন ও কর্ম’। ‘দ্য বুক অব হান’ বইয়ে শিক্ষাকে সমাজের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে অপরিহার্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কোরিয়ায় রাজ্য চালিত শিক্ষা ব্যবস্থা (পাবলিক এডুকেশন সিস্টেম) প্রতিষ্ঠিত হয় ৩৭২ খ্রিষ্টাব্দে। ঐতিহাসিকভাবেই কোরিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থা কনফুসিয়ানিজম ও বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। কোরিয়ায় ‘তিন রাজ্য’ আমলে শিক্ষা কাঠামোতে তারই প্রভাব স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। খোগুরিও রাজ্যে (৩৭ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) আগে থেকেই লেখার প্রচলন ছিলো এবং এই সময়কালে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ইয়ুগি বই (유기; 留記) থেকে তা স্পষ্ট ভাবে জানা যায়। এসময়ের শিক্ষা ছিলো সমাজের অভিজাত শ্রেণি তথা ইয়াংবান শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় তায়েক্সু (태학; 太學); যা দেহাক নামেও পরিচিত ছিলো। তায়েক্সু এর অর্থ হলো রাজ্য একাডেমি বা রাজ্যের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষা দর্শন, কনফুসিয়ানিজম, বৌদ্ধ দর্শন, বিভিন্ন কলা এবং মার্শাল আর্টস শেখানো হতো। সে রাজ্যে খিয়েংদং নামে আরও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আনুমানিক ৩৭২ খ্রিষ্টাব্দে।
যদিও বেকজে রাজ্যে (১৮ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ) সুনির্দিষ্ট কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জানা যায় না, তথাপিও জাপানের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিভিন্ন দলিলে ও বিভিন্ন প্রাচীন লেখাসমূহে (যেমন- নিহন সোকি, কোজিকি, থাউজেন্ড ক্যারেকটার ক্লাসিক্স, এনালেটস) বেকজে রাজ্যের শিক্ষার প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়।
শিল্লা রাজ্যের (৫৭ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (প্রতিষ্ঠান না বলে আসলে ক্লাব বলা বেশি সঠিক) ছিলো হওয়ারাং যেখানে মূলত মার্শাল আর্টস চর্চা হতো। হওয়ারাং মূলত একদল অভিজাত যুদ্ধ ও কৌশলী (গোপন জ্ঞানসিদ্ধি লাভে সিদ্ধ পুরুষ) কে ও তাদের চর্চা কেন্দ্রকে বোঝাতো। শিল্লা রাজ্য কোরিয়ার বাকি দুই রাজ্য কর্তৃক উপুর্জুপুরি আক্রমণের শিকার হওয়ায় সে রাজ্যের শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিলো যুদ্ধবিদ্যা ও যুদ্ধ কৌশল শেখা। তবে একই সাথে ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদিও পাঠের অংশ ছিলো।
পরবর্তীতে একীভূত শিল্লারাজ্য কালে (৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দ) শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তর প্রসার লাভ করে। একীভূত শিল্লা রাজ্য চায়নার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে চায়নার বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত এবং চায়নার সাথে এদের শিক্ষার্থী বিনিময় বা স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ কর্মসূচির প্রচলন ছিলো। একীভূত শিল্লা রাজ্যে কোগুরেও বা খোরেইও নামে বহুল প্রচলিত এবং সে সময়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো খুকহাক (국학) যার শিক্ষাক্রম চীনের তাং গোত্র এর নিকট থেকে নেওয়া। চীনের তাং আমল ছিলো স্বর্ণ যুগ এবং কোরিয়া সহ চারপাশের রাজ্যসমূহের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এদের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলো।
খোরিয়ো শাসন আমলে (৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দ) শিক্ষাক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মের দারুণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যদিও সামাজিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে কনফুসিয়ানিজম এর দারুণ প্রভাব ছিলো। খোরিয়ো এর খোয়াংজং এর শাসনামলে (৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) কনফুসিয়ানিজম এর প্রভাবে খোয়াগ’হ (과거) পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। তবে আরও পরে, সিওনজং এর শাসনামলে (৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) শিক্ষা বিষয়ক প্রথম নীতির সন্ধান মেলে। এখানে উল্লেখ্য যে, সেই নীতিসমূহও কনফুসিয়ানিজম দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলো। ৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রামঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার লাভ করে। ১১২৭ খ্রিষ্টাব্দের এক নীতি থেকে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় রাজ্য অর্থায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানা যায়। এসব বিদ্যালয়ে দ্য বুক অব ফিলিয়াল পিয়েতি এবং কনফুসিয়ান রীতিনীতি ও দর্শন পড়ানো হত। বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার মূল্যায়ন করা হত। সে সময়ে দুই ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো – খোয়ানাক (관학) এবং সাহাক (사학)। রাজ্য অর্থায়িত (বা প্রতিষ্ঠিত) ও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে খোয়ানাক বলা হত এবং যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ রাজ্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নয় বা রাজ্য নিয়ন্ত্রিত নয় সেগুলোকে বলা হতো সাহাক। শহরের খোয়ানাকসমূহ কে বলা হত হাকদাং (학당) এবং গ্রামাঞ্চলের খোয়ানাকসমূহ পরিচিত ছিলো হ্যায়াংগিয়ো নামে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সম্মিলিত উয্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সিবিদো (십이도) এবং সিওদাং (서당) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে পরবর্তী সময়ে এ দুটি প্রতিষ্ঠান উত্তরোত্তোর শিক্ষার মানোন্নয়নে রাজার বিশেষ অনুদান পেতো। কোরিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় খুকজাগাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে। এছাড়াও রাজ্যের শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে রাজার বিশেষ অর্থসাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক শহর কেন্দ্রিক লাইব্রেরি যেগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলো বিশুহোন (비서원) এবং সাসুহোন (수서원)।
জোসন বংশের শাসনামল কোরিয়ার জন্য সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে জোসন শাসনামল শেষ হয় ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে জাপানিজ শাসন শুরু হওয়ার মাধ্যমে। খোরিয়ো শাসনামলের শেষের দিকে বৌদ্ধদর্শন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং কনফুসিয়ানিজম এর বিস্তার ঘটে যা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সাথে শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষাদর্শনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। এবং সম্ভবত সে কারণেই, ইয়াংবান (রাজ পরিবার, রাজ সভাসদগণ এবং রাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী) বা অভিজাত শ্রেণির শিক্ষাকে সাধারণের শিক্ষার থেকে অধিক মূল্য দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। শিক্ষা পদোন্নতি ও ব্যক্তিগত অর্জনের অবলম্বন হয়ে ওঠে। কলা শিক্ষা অধিক মূল্য পেতে শুরু করে এবং ফলস্বরূপ বৃত্তিমূলক শিক্ষা গুরুত্ব হারায়। যদিও পরবর্তী সময়ে এই পরিবর্তন কোরিয়ার সামগ্রিক শিক্ষা দর্শন ও জাতিগত নৈতিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রসংসা লাভ করে, তথাপিও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার ভূমিকা পর্যালোচনায় তা (বিশেষভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাওয়া) দারুণভাবে সমালোচিত হয়ে থাকে। সিওদাং এর মত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ, শাউয়ান এর মত বেসরকারি বিদ্যালয়সমুহ, গ্রামাঞ্চলে হেয়াংগিও এবং শহরাঞ্চলের সাহাক এর মত মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠানসমূহ যতটা না পদ্ধতি নির্ভর ছিলো তার চেয়েও বেশি স্বাধীন ছিলো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সউল এর সংগিয়ংগোয়ান (성균관) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করতো। জোসন আমলের ছয় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ‘মিনিস্ট্রি অব রাইটস’ (রীতিনীতি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়) শিক্ষার শিক্ষাক্রমের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতো। খিইয়ংগুক দেজন (경국대전), যা তৎকালীন শিক্ষানীতি হিসেবে পরিচিত ছিলো, অনুযায়ী রাজ্যের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালিত হত। বিদ্যালয়সমূহ রাজার নিকট থেকে ফসলী জমি, চাল ও মাছ ইত্যাদি সাহায্য হিসেবে পেতো। উপরন্তু সেসকল সম্পদ এর খাজনা মওকুফ ছিলো। ১৩৯৮ সালের খুরেইও শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সাংখিয়ানখোয়ান ইনস্টিটিউট কনফুসিয়ান আদর্শে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১০০ থেকে ২০০ এর মত। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরণের আয়োজন করতো এবং জাতীয় স্বার্থে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা হত। উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণ রাজার দরবারে বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হত। ১৪১১ সালে স্থাপিত চারটি সাহাক খুরেইয়ো শাসনামলের সাহাকসমূহের থেকে ভিন্ন ছিলো। এই চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি আমলা প্রশিক্ষণের উদ্দেশে প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিলো (অনেকটা আমাদের দেশের বিসিএস পরীক্ষার মত)। এই ব্যবস্থা কে সিউংবো নামে ডাকা হতো। ১৪২৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজ পরিবারের জন্য জোঘাক (종학) নামে এক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জোসন শাসনামলে কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশ পদ্ধতিগত পরিসরে বিকাশ লাভ করে এবং এই শাসনামলের শেষের দিকে এসে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকখানি গোছানো ও পদ্ধতিনির্ভর হয়ে ওঠে।
জোসন শাসনামলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কোরিয়ার ভাষার বর্ণমালার সৃষ্টি। ১৪৪০ সালে রাজা সেজং রয়্যাল সোসাইটির পণ্ডিতদের সরল ও সহজবোধ্য একটি নতুন বর্ণমালা প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। প্রায় একশ ভাষাবিদের তিন বছরের প্রচেষ্টায় প্রণীত হয় কোরিয়ান ভাষার স্বতন্ত্র বর্ণমালা হুনমিন-ঝং উম (Hunmin-chongum)। মানুষের বাক-প্রত্যঙ্গ মুখ, জিহ্বা ও কণ্ঠনালীর উপর দীর্ঘ গবেষণা করে তাঁরা মোট ২৮ টি অক্ষর (১৭ টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১১ টি স্বরবর্ণ) প্রস্তাব করেন। আরও তিন বছর আলোচনা-পর্যালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পণ্ডিতগণ ১৪৪৬ সালে বিস্তারিত ব্যাখ্যা, উদাহরণ ও পূর্ণ ব্যাকরণসহ হুনমিন-ঝং উম বর্ণমালা রাজার কাছে হস্তান্তর করেন। এ বছরের অক্টোবর মাসে রাজা সেজং কোরিয়ানদেরকে তাঁদের সম্পূর্ণ নিজস্ব বর্ণমালাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপহার দেন। (এ বিষয়ে বিস্তারিত)
উনিশো শতকের শেষভাগে এসে কোরিয়ায় বৈশ্বিক সংস্কৃতির কিছুটা অনুপ্রবেশ ঘটে, কিছুটা বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষিত কোরিয়ান এবং বাকিটা বিদেশি খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাত ধরে। উনিশো শতকে কোরিয়ার জাতীয় শিক্ষা দর্শন ছিলো সকলের শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষায় সামাজিক সমতা। উনিশো শতকের দুটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো খোয়ানাক দংমুনহাক (동문학) এবং ইউকিয়ংগোংগোয়ান (육영공원)। দংমুনহাক অনুবাদকদের প্রশিক্ষণের জন্য এবং ইউকিয়ংগোংগোয়ান ইয়াংবানদের শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত। এসময়ে স্থাপিত বিদ্যালয়সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা হতো – ধর্ম কেন্দ্রিক বিদ্যালয় (ক্রিশ্চিয়ান স্কুল) এবং সিভিলিয়ান বিদ্যালয় (সিভিলিয়ান স্কুল)। ১৮৯৪ সালের গাবো শিক্ষা সংস্কার এর মাধ্যমে এ শতকের শেষের দিকে কোরিয়ার শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কাঠামোতে দারুণ পরিবর্তন আসে। এই শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে সম্রাট গোয়াংমু কোরিয়ায় বিদেশি শিক্ষা চালুর অনুমোদন দেন।
উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কোরিয়ার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কোরিয়ার শিক্ষা ছিলো জীবন দর্শন ও জীবনে প্রয়োজন কেন্দ্রিক। বৌদ্ধ ধর্ম ও কনফুসিয়ানিজম এর মিশ্রণে শিক্ষা একদিকে যেমন ধীরে ধীরে পদ্ধতি নির্ভর হয়ে ওঠে, তেমনি হয়ে ওঠে সকলের মঙ্গলের নিমিত্তে। খোরেইও ও জোসন হাজার বছরের শাসনামলে শিক্ষার ভিত শক্ত হয়ে উঠলেও, তা রয়ে যায় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সেই অবস্থা থেকে কিভাবে বিংশ শতাব্দীতে স্বল্প সময়ে কোরিয়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় শিক্ষার আলো, কিভাবে পুরো জাতি শিক্ষা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অর্জন করে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট – সে গল্পই হবে আগামী পর্বে।
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা এর অন্যান্য পর্ব:
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (প্রথম পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (তৃতীয় পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (চতুর্থ পর্ব)
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (শেষ পর্ব)