পাখিটির নাম ‘বার্ড অব প্যারাডাইস’। বাংলায় বলতে পারেন ‘স্বর্গের পাখি’। তবে ওদের আবাস কিন্তু এই মর্ত্যেই। ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ায় দেখা মেলে এদের। পাখিগুলোর বিশেষত্ব- চোখ ধাঁধানো নাচ। যে কেউ দেখলে আকৃষ্ট না হয়ে উপায় নেই। অবশ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ওরা নাচে না; পুরুষ পাখিগুলো নাচে সম্ভাব্য সঙ্গীকে কাছে টানতে। স্ত্রী পাখির কাছে নিজের আকর্ষণ বাড়াতে নানা ভঙ্গিতে নাচে ওরা। বলা হয়ে থাকে এই পাখিটিকে দেখেই নাকি নাচতে শিখেছে মানুষ!
অন্য প্রাণিদেরও নাচতে দেখা যায়। যেমন ‘স্নোবল’ নামের কাকাতুয়া। নৃত্যশিল্পে বিশেষ খ্যাতি আছে এদের। এছাড়া নাচতে পারে সি লায়নরাও। খুব বেশি পারদর্শী না হলেও অনেক প্রাণিকেই কয়েক বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে জটিলসব নাচের মুদ্রার শেখানো যায়।
এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একটি বিতর্ক রয়েই গেছে- নৃত্য কি মানুষের একক দক্ষতা? অথবা প্রাণিরাজ্যের সঙ্গে আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস থেকেই নৃত্যের উৎপত্তি? এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দুটি প্রধান তত্ত্ব পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে কোনটি সত্য তা এখনো নিশ্চিত নয়।
আসলে এখন পর্যন্ত নৃত্যের কোনো সংজ্ঞাই নির্ধারণ করা যায়নি। এ কারণে মানুষের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে অন্য প্রাণিদের একই আচরণ তুলনা করাও কঠিন। তবে নাচের বিভিন্ন অংশকে আলাদা করে চিন্তা করা হলে মানুষ এবং অন্য প্রাণিদের অঙ্গভঙ্গির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।
এমন কিছু মৌলিক দক্ষতা আছে, যা উভয় প্রজাতির মধ্যেই দেখতে পাওয়া যাবে, এর একটি হচ্ছে- নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট তাল বজায় রেখে নাচা, মানুষ যেটা সুর বা সঙ্গীতের তালে করে। আরেকটি হচ্ছে- একইসঙ্গে নাচের ক্ষেত্রে অপরজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নাচা। এখানে অন্যকে অনুসরণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটিই মূলত নৃত্য অনুরাগীকে আরো জটিল নাচ শিখতে দক্ষ করে তোলে।
তবে নাচের মতো এসব বিক্ষিপ্ত অঙ্গভঙ্গির সঙ্গতি আরো কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। উদারহণ হিসেবে বলা যায়, সুর বা সঙ্গীতের শব্দ মূলত আমাদের মস্তিষ্কের শ্রবণ অংশের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়। তাছাড়া দেহের নড়াচড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে মস্কিষ্কের ‘মোটর কর্টেক্স’ অংশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ কলেজ অব ফ্লোরিডার গবেষক পিটার কুক বলেন, ‘মানুষের অন্য আচরণ থেকে নাচকে আলাদা করার কোনো প্রয়োজনীয় মানদণ্ড আমার জানা নেই।’
তবে প্রাণিরাজ্যের সদস্যদের নৃত্যের প্রধান অংশগুলো নিয়ে গবেষণা দিন দিন সহজ হয়ে উঠছে। এরপর পর থেকে গবেষকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে নৃত্যের উদ্ভব এবং বিকাশ নিয়ে। অবশ্য এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে গত দশক থেকে, ২০০৭ সালে যখন স্নোবল কাকাতুয়ার নাচের একটি ক্লিপ প্রথমবার অনলাইনে দেখা যায়। আগে মনে করা হতো, শুধু মানুষই আরেকজনের সঙ্গে তাল রেখে নাচতে পারে। কিন্তু ওই ক্লিপে দেখা যায়, সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুটি পাখি একই ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার উপসংহার টানলেন, স্নোবল নাচতে পারে কারণ এটি স্বরযুক্ত প্রজাতির পাখি। এই স্বরই তাকে শব্দের স্পন্দন বুঝতে সহায়তা করে। এজন্য দুটি পাখি একে অপরকে অনুসরণ করতে পারে। গত এক দশকের গবেষণা শেষে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, নাচের একটি প্রধান উপায় হচ্ছে অনুকরণ দক্ষতা। এ ধরনের অনুকরণকে বলা হয় ‘মোটর ইমিটেশন’।
তবে এখানে এসে গবেষকদের মধ্যে আরেকটি প্রশ্নের উদয় হয়- জটিল ছন্দের সঙ্গেও মানুষ কীভাবে অনায়াসে নাচতে পারে, যেখানে কুকুর, বানর এবং বিড়ালের মতো প্রাণিগুলো পারে না। এর জন্য আগে এডগার ডেগাসের ‘দ্য ডান্স ক্লাস ১৮৭৩-৭৬’ নামক চিত্রকর্মটি দেখতে হবে। এতে দেখা যায়, একদল মেয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের নাচ দেখছে। এরপর তারাও ওদের মতো করে নাচবে। আমাদের ব্যতিক্রমী অনুকরণ দক্ষতার জন্য এই চিত্রকর্মটি একটি ভালো উদাহরণ।
২০১৬ সালের ওই গবেষণাপত্রের গবেষক ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকি ক্লেটন জানান, ‘প্রাণিদের মোটর ইমিটেশনের সবচে শক্তিশালী উদাহরণ, তারা মানুষের মতোই নাচতে পারে। নাচের ক্ষেত্রে একজনকে শুধু একটি দৃশ্যই নকল করতে হয় না, দৈহিক ভঙ্গিমায় তা ফুটিয়েও তুলতে হয়। এটাই হচ্ছে নাচের আসল ব্যাপার।’ এ কারণে স্বরদক্ষতা নৃত্যের দক্ষতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও দাবি তার এবং সহযোগীদের।
একে বলা হয় ‘ভোকাল লার্নিং হাইপোথিসিস’। ২০০৬ সালে প্রথম বিষয়টি আলোচিত হয়। তখনকার একটি গবেষণায় বলা হয়, শুধু স্বরদক্ষতাসম্পন্ন প্রাণিরাই (গায়ক) নির্দিষ্ট ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে পারে। ২০০৮ সালে পাখিদের মস্তিষ্ক নিয়ে এক গবেষণায় বলা হয়, প্রাণিদের নড়াচড়া এবং স্বরশিক্ষা বিষয়ক মস্তিষ্কের অংশ দুটি পাশাপাশি অবস্থান করে এবং পরেরটি শুধু ভোকাল লার্নিংয়ের কাজটিই করে না, এটি নড়াচড়ার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
ভোকাল হাইপোথিসিসের বিষয়টি যদি সঠিক হয়, তবে ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে পারার দক্ষতা শুধু স্বরসম্পন্ন প্রাণি প্রজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। টিয়া বা অন্যান্য গায়কপাখি; তিমি, ডলফিন এবং শুশুক; এবং সি লায়ন বা সিল মাছের মতো সব প্রাণিই ওই দক্ষতা থাকার কথা। কারণ এসব প্রাণির বেশিরভাগই স্বরসম্পন্ন।
ক্লেটন এবং তার সহকর্মীদের মতে, নৃত্য আসলে অনুকরণের উপজাত একটি বিষয়। কুক বলেন, ‘হতে পারে, আমরা যদি স্বাধীনভাবে নাচতে শিখতাম তবে ভালো নৃত্যশিল্পী হতে পারতাম না।’
তবে নৃত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত আরো কিছু ধারণাও রয়েছে।
কুক এবং তার সহকর্মীদের মতে, ভোকাল লার্নিং পুরো বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ২০১৬ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, অনুকরণটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও নাচের ক্ষেত্রে অনুকরণের বাইরে আরো কিছু আছে।
যারা নতুন নাচ শিখতে যায়, তারা কোনো অনুকরণ ছাড়াই নির্দিষ্ট ছন্দের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে নিজেদের পা দোলাতে পারে। আর তাই শুরু থেকেই তারা নাচের অনেক কিছু বুঝতে পারে। কুক বলেন, ‘মানুষের নাচের জন্য মস্তিষ্কের যে অংশে পরিবর্তন দরকার তা মূলত অর্জিত হয় একটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট ছন্দ চর্চার দক্ষতা থেকে।’ এই দক্ষতাটিই প্রাণিরাজ্যে ব্যাপকভাবে আরোপ করা যায়।
উনিশ শতকের জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ঠিক এমনটাই চিন্তা করেছিলেন। ১৮৭১ সালে তিনি তার ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’ বইতে লেখেন, ‘সুরের মূর্ছনা এবং ছন্দের উপলব্ধি সম্ভবত সব প্রাণির মধ্যেই পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে এটা স্নায়ুব্যবস্থার সাধারণ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে।’
২০১৩ সালে একটি গবেষণাপত্রে কুক লেখেন, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সি লায়ন স্বরহীন হওয়া সত্ত্বেও ছন্দের তালে নাচতে পারার অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। ছন্দের সঙ্গে তাল রেখে এটি তার মাথা দোলাতে পারে। প্রশিক্ষককে অনুকরণ না করেই নাচতে পারে। এছাড়া মানুষের সবচে কাছের প্রজাতি প্রাইমেটদেরও ছন্দ বোঝার দক্ষতা আছে। বানর এবং উল্লুকরা গাছের গুঁড়ি বাজিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট সুর তৈরি করতে পারে এবং একই সময়ে তারা সমস্বরে গেয়ে উঠতে পারে।
মানুষের দূরবর্তী কিছু প্রজাতিরও ছন্দের দক্ষতা আছে। এর মধ্যে গোল পায়ের কাঁকরা ও পা দোলানো ব্যাঙ অন্যতম। এরা নিজেরাই সুর তৈরি করে নাচতে পারে। কুকের মতে, এগুলো কিছুটা নাচের মতোই দেখায়। তাই তিনি মনে করেন, নাচের জন্য ছন্দ আবশ্যকীয় এবং এটা প্রাণিরাজ্যের সব জায়গায়ই দেখা যায়। তবে ভঙ্গিমার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে।
পুরো ব্যাপারটা আসলে জটিল। এমন অনেক প্রাণি আছে, যাদের ভোকাল লার্নিং খুব ভালো হলেও ছন্দ তৈরিতে খুব বাজে। এটা ভোকাল লার্নিং হাইপোথিসিসের জন্য দুঃসংবাদ। আবার কুকের ছন্দের সার্বজনীন ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জেব্রা ফিঞ্চ নামের এক ধরনের গায়ক পাখি ছন্দ বুঝতে পারে না এবং আলাদা ছন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব লেইডেনের ওই গবেষণায় বলা হয়, অনেক প্রাণি আছে, যারা ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে পারে কিন্তু ছন্দ বুঝতে পারে না। জেব্রা ফিঞ্চের চেয়ে আমাদের আরো কাছের প্রজাতি রেসাস ম্যাকাকিইস বানর। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখে গেছে, এরাও সুর বুঝতে পারে না।
তাহলে প্রাণিদের নৃত্য দক্ষতার ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
একটি হতে পারে প্রাণিদের ওপর সঠিক পরীক্ষা এখনো চালানো যায়নি। যেমন: বানর এবং উল্লুকের কিছু ছন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকলেও তা আমাদের মতো নয়। অথবা অন্যটি হতে পারে, নাচের জন্য দেহের ওপর অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়। আর এজন্য বানরের চেয়ে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনেক বেশি। আমাদের চেয়ে বানরের শ্রবণক্ষমতাও অনেক দুর্বল।
এ নিয়ে বর্তমানে শিম্পাঞ্জির ওপর গবেষণা চলছে। এতে দেখা যায়, তারা মানুষের আঙ্গুলের ইশারার ছন্দ অনুকরণ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত একটি বিষয়ই প্রমাণিত হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা- এতদিন ধরে মানুষ এবং প্রাণিদের নাচকে একই ধরনের মনে করার যে ধারণা আমাদের মধ্যে ছিল তা সঠিক নয়।
তবে সঠিক কোনটি? অনেক বিশ্লেষকের মতে, নাচ এবং গান একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি ছাড়া অন্যটি হয় না। তবে এটা প্রমাণ করা যায়নি। মানুষ দুটির একটি ছাড়াই অন্যটি করতে পারে। ঠিক একই অবস্থা বার্ড অব প্যারাডাইসের। তাদের কোনো কোনো প্রজাতি সঙ্গীত ছাড়াই নৃত্য প্রদর্শন করতে পারে। আবার কোনো কোনোটি নাচ ও গান একসঙ্গেই করে। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার লায়ারবার্ডও গান না গেয়েই নাচতে পারে- ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, নাচ ও গানের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য কোনো সম্পর্ক নেই। এই সম্পর্ক স্বেচ্ছামূলক। গবেষণায় বলা হয়, এটা পরিষ্কার যে পাখির সুর এবং নৃত্য প্রদর্শনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। এসব পাখির জন্য নাচ এবং গান সম্পর্কহীন।
এ নিয়ে এখনো কোনো একক তত্ত্ব এখনো নেই। তবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো মত দেখা গেল এর সবগুলোই মানুষের নৃত্যের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা যায়। সেক্ষেত্রে এই বার্ড অব প্যারাডাইসের কাছ থেকেও নাচ শিখে থাকতে পারে মানুষ। বাকিটা জানার জন্য আরো গবেষণার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বিবিসি অবলম্বনে