প্রতি বছর সারা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষাভাষীর বিজ্ঞানীরা প্রচুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করেন। এসব গবেষণা প্রতিবেদন বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত প্রকাশও হয়ে আসছে। বিশ্বায়নের এ যুগে নবসৃষ্ট এসব জ্ঞানেরও বিশ্বায়ন প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো বড় বাধা হিসেবে ভাষাগত দূরত্বের বিষয়টি রয়ে গেছে। কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিবেদনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজিকে বিবেচনা করা হলেও এখনো এর একটি বড় অংশই প্রকাশ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। ফলে এক ভাষাগত দূরত্বের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ফলাফলই মানুষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না। খবর সায়েন্সডেইলি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিবেদনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখনো ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয় না। ফলে এসব গবেষণা প্রতিবেদন অনেক সময় নজরেই পড়ে না, যা পৃথিবীকে বোঝা ও আমাদের জ্ঞানের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা তৈরি করছে। সম্প্রতি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল এ-সম্পর্কিত একটি গবেষণা চালায়। গবেষকদের মতে, ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তথ্য আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে বোধগম্য না হওয়ায়, এমনকি ওইসব বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তৃত পরিসরের গবেষণাও পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি এ-বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন পিএলওএস বায়োলজি জার্নালে প্রকাশ হয়েছে।
গবেষণায় বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের অন্যতম বৃহত্তম ও উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার গুগল স্কলারের ওয়েব প্লাটফর্মটি ব্যবহার করা হয়। সেখানে ২০১৪ সালে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট ১৬টি ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ওই বছর সংশ্লিষ্ট ১৬টি ভাষায় এ বিষয়ের ওপর মোট ৭৫ হাজার গবেষণা প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশই ইংরেজিতে লেখা হয়নি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে স্প্যানিশ। এ ভাষায় প্রকাশ হয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ গবেষণা প্রতিবেদন। এছাড়া পর্তুগিজে ১০ দশমিক ৩, সরলীকৃত চীনা ভাষায় ৬ ও ফরাসি ভাষায় ৩ শতাংশ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া জার্মান, জাপানিজ, কোরিয়ান, সুইডিশসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ হয়েছে আরো কয়েক হাজার গবেষণা প্রতিবেদন। আর এসব ভাষায় প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের মধ্যে গড়ে ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রে সারাংশটি ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। ফলে ইংরেজিতে লিখে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে অনুসন্ধান করলে এসব গবেষণা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না।
এদিকে অধিকাংশ গবেষণা প্রতিবেদন ইংরেজিতে প্রকাশ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ আবার ওইসব গবেষণার তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাদের মতে, ঠিক বিপরীতভাবে বিশ্বের তাবত্ গবেষণার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই প্রকাশ হচ্ছে ইংরেজিতে। এতে করে ইংরেজি প্রধান ভাষা নয়, এমন দেশের মানুষ এসব গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষত পরিবেশ সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে ভাষাগত এ ব্যবধান বড় সংকটের সৃষ্টি করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। অথচ এক্ষেত্রে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দুই ক্ষেত্রেই ভাষাগত বড় প্রতিবন্ধকতা এখনো রয়ে গেছে।
ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাতসুয়া বলেন, যখন আমরা গবেষণামূলক নিবন্ধের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির কথা বলি, এর অর্থ এই নয় যে, অন্য ভাষাগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং আমরা বলতে চাইছি যে, ভাষার দূরত্ব আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি আত্তীকরণের পক্ষে এখনো একটি বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। বণিক বার্তা।