অজানা আর গোপন বিষয়ের প্রতি মানুষের কৌতূহল চিরকালের। একজন ভ্রমণপিপাসুর জন্য তো কথাই নেই। নিষিদ্ধ জায়গাগুলোই তার মধ্যে বেশি আগ্রহের সৃষ্টি করে। এমন কিছু গোপন জায়গার তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নোত্তরভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘কিওরা’র ব্যবহারকারীদের কাছে। উত্তরে তারা সন্ধান দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে গোপন পাঁচটি স্থানের:
এসভালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট, নরওয়ে
ভাবুন তো এমন একটি পৃথিবীর কথা, যা ভয়ঙ্কর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাল্টে গিছে চিরদিনের জন্য, ধ্বংস হয়ে গেছে গোটা জনসংখ্যা, পুরো অবকাঠামো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেখানে নেই কোনো খাবার। এ অবস্থায় একাকি একজন নতুন করে আবার সাজিয়ে তুলতে চাইছেন বিশ্বকে।
এটা যদি হলিউডের কোনো সিনেমা হয় তবে পুরো পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে নায়ককে কোথায় যেতে হবে? বৈশ্বিক এই খাদ্য সঙ্কটের মোকাবেলায় তাকে শেষমেশ যেতে হবে নরওয়ের এসভালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্টে। নরওয়ের উত্তর মেরুর বরফ দ্বীপ স্পিটসবার্গেনের ১২০ কিলোমিটার ভেতরে স্যান্ডস্টোন পাহাড়ে অবস্থিত জায়গাটি। উত্তর মেরু থেকে ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্লোবাল সিড ভল্ট শক্ত নিরাপত্তাবেষ্টিত সুরক্ষিত একটি জায়গা।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছিল এটি। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সারা পৃথিবী বিধ্বস্ত হলে তার সমাধান হিসেবে আগেই এখানে বিভিন্ন শস্য সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি প্যাকেটে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ২৫০ কোটি শস্য বীজ সংরক্ষণ করা আছে এখানে।
বিজ্ঞানীরা জায়গাটি ব্যবহারের পেছনে কারণ- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই দ্বীপ পুরোটাই বরফে আচ্ছাদিত। আর এজন্য বীজ সংরক্ষণের একটি আদর্শ জায়গা এটি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বরফ গলে যাওয়ার হাত থেকেও জায়গাটি নিরাপদ। তাই এখানে শস্য বীজ হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত গবেষক এবং উদ্ভিত প্রজননবিদ না হলে এই ভল্টের ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
নিহাউ, হাওয়াই
গাছপালা বেষ্টিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটি অতি ক্ষুদ্র দ্বীপ হচ্ছে নিহাউ। স্থানটিতে গেলে দেখা যাবে একের পর এক পাম গাছের সারি। অথচ মানুষ বাস করে অল্প কয়জন। আদর্শ পর্যটকনকেন্দ্র হতে পারতো এটি। কিন্তু পর্যটনকেন্দ্র তো দূরের কথা ১৮০ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটিতে বহিরাগতদের প্রবেশই নিষিদ্ধ।
১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রবিনসন পরিবারের কাছে এটি বিক্রি করে দেন হাওয়াইয়ের রাজা কামিহামিহা। ১৯১৫ সাল থেকে দ্বীপে বহিরাগতদের প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। জীবনযাত্রা একটু অস্বাভাবিক। ১৩০ জনের মতো আদিবাসী বাস করেন এখানে। এদের বাহন ঘোড়া আর সাইকেল। বিদ্যুৎ আসে সৌরপ্যানেল থেকে। দ্বীপে নেই কোনো খাবার পানিও। খাবার দাবার আনতে হয় পাশের আরেকটি দ্বীপ থেকে। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা ডিঙ্গি নৌকায় করে সপ্তাহে একদিন পাশের দ্বীপ কাউয়াইতে যায় পড়াশোনার জন্য।
দ্বীপটির আবার একটি আকর্ষণীয় ইতিহাসও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবার আক্রমণের পর জাপানি এক পাইলট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এই দ্বীপে গিয়ে পড়েন। ‘নতুন প্রজাতির’ কাউকে দেখে রীতিমতো তখন সপ্তাহখানেক আতঙ্কে ছিলেন স্থনীয়রা। ১৯৪৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এখানে জাতিসংঘের সদরদফতর করবেন বলে ভেবেছিলেন। বর্তমানে দ্বীপটি জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ।
রয়াল এয়ারফোর্স মেনউইথ হিল, ইংল্যান্ড
জেমস বন্ডের সত্যিই যদি কোনো গোপন আস্তানা থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে ইংল্যান্ডের রয়াল এয়ারফোর্স মেনউইথ হিল। বলা হয়, নিউ ইয়র্কশায়ারের এই বিমান ঘাঁটিতে বিশ্বের সবচে বেশি বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা গোপন তথ্যের সন্ধান করেন।
স্নায়ুযুদ্ধকালীন সোভিয়েত বাহিনীর যোগাযোগের উপর নজরদারি করতে ১৯৫৪ সালে গোপন এই ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখন কী কাজে এটি ব্যবহার করা হয় তা কাউকে জানানো হয় না। ধারণা করা হয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস এবং মাদক পাচারের তদন্ত হয় এখানে। তাছাড়া মার্কিন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবেও নাকি ব্যবহার করা হয় এই দ্বীপ। দুঃখের বিষয়, কোনো অবস্থাতেই এই ঘাঁটি ঘুরে দেখার উপায় নেই।
সিক্রেট আর্কাইভ, ভ্যাটিকান
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যক্তিগত পাঠাগার হিসেবে অভিহিত করা হয় ভ্যাটিকানের সিক্রেট আর্কাইভকে। অষ্টম শতাব্দী থেকে এ পর্যন্ত পোপদের ব্যক্তিগত নথিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে এই পাঠাগারে। আর সেগুলো তালা দিয়েও রাখা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে। ভেতরে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু গবেষক এবং জ্ঞানী-গুণীরাই ঢুকতে পারেন, তবে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে। সে প্রক্রিয়াও আবার অত্যন্ত জটিল।
পাঠাগারের ভেতরে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার বইয়ের দীর্ঘ তাক রয়েছে। সেখানে রাখা আছে ৩৫ হাজার ভলিউম নথি। এটিকে পোপের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এরিয়া ফিফটি ওয়ান, নেভাডা
ভেগাসে যা ঘটে তা ভেগাসেই থেকে যায়। এখানকার কোনো তথ্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই কথাটি সবচে বেশি প্রযোজ্য লাসভেগাস থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি গোপন জায়গার ক্ষেত্রে। জায়গাটির নাম এরিয়া ফিফটি ওয়ান।
প্রথম এই নাম ব্যবহার করা হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর নথিতে। একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি রয়েছে এই এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের সব গোপন জিনিস নাকি মজুদ করা হয় এখানে। তবে নিশ্চিতভাবে কেউই জানে না আসলে কী হয় এই এরিয়া ফিফটি ওয়ানে। এ ব্যাপারে কখনো তথ্য প্রকাশ করে না সিআইএও।
আর এসব কারণেই এই জায়গা নিয়ে আছে নানান রটনা, গুজব। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। এখানে নাকি ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের মৃতদেহ সংরক্ষিত রাখা হয়, এমন কথাও প্রচলিত আছে। সত্যটা হয়তো আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না। এখানকার সবকিছুই করা হয় অত্যন্ত গোপনে। বহিরাগতদের প্রবেশও নিষিদ্ধ।
বিবিসি অবলম্বনে