সোয়েটার প্রস্তুত ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের এমআর সোয়েটার কম্পোজিট গ্রুপ। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি কাজ না থাকায় ২০১৫ সালের জুনে গ্রুপের পোশাক কারখানা ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে কাজ না থাকায় গত বছরের জুলাইয়ে বন্ধ হয়ে গেছে অ্যারাউন্ড স্টারস সোয়েটার্স লিমিটেড। এভাবে গত আড়াই বছরে দেশের চার শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে ৫৩০টি কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
দেশে শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চল রয়েছে চারটি— আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম। এ অঞ্চলগুলোয় বিভিন্ন শিল্প খাতের কারখানা রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৩ হাজার ২০০টি পোশাক কারখানা। এর মধ্যে ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আলোচ্য অঞ্চলগুলোয় বন্ধ হয়ে পড়া কারখানার সংখ্যা ৫৩০। এ হিসাব অনুযায়ী, আড়াই বছরে অঞ্চলগুলোয় প্রতি মাসে বন্ধ হয়ে পড়েছে গড়ে ১৭টি করে কারখানা।
সূত্র জানিয়েছে, এসব এলাকায় অনেক কারখানা রয়েছে, যেগুলো নানা কারণে শ্রম আইন অনুযায়ী সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে মালিকপক্ষের সুবিধা অনুযায়ী তা আবার চালু করা হয়। কিন্তু আলোচ্য কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর চালু হয়নি।
অনুসন্ধানে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এর বেশির ভাগই বন্ধ হয়েছে কাজ না থাকার পাশাপাশি লোকসানের কারণে। এছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে রয়েছে আর্থিক অসচ্ছলতা, ব্যাংকের দায়, কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়া, গ্যাস সংকট, অগ্নিকাণ্ড, কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, পুরনো মেশিন ও শ্রমিক অসন্তোষ। এসব কারণে কারখানা চালু রাখতে ব্যর্থ হয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে কয়েকটি।
কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে এমআর সোয়েটার কম্পোজিট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার মবিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৫ সালে আমরা গ্রুপের সুইং ইউনিটটি বন্ধ করে দিই, যার মূল কারণ পর্যাপ্ত কাজের ঘাটতি। এছাড়া ব্যাংকের দেনার বিষয়টিও কাজ করেছে। কাজের অভাবে লোকসানে কারখানা চালু রেখে দেনার দায় বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। ফলে ইউনিটটি বন্ধ করে দিতে হয়।
২০১৪ সালের এপ্রিলে এক অগ্নিকাণ্ডে ফার্নিচার শিল্পের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান অটবির একটি ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ইউনিটের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তটিকে চালু করা যায়নি এখনো। ওই সময়ে এ ইউনিটে শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৯০০। এভাবে আড়াই বছরে মোটামুটি সব খাতেই কারখানা বন্ধের ঘটনা ঘটেছে।
শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র-মাঝারি-বড় সব ধরনের কারখানাই রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক কারখানা রয়েছে, যেগুলো কাজ করত সাব-কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি আবার বিজিএমইএ বা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য নয়। রানা প্লাজার পর কারখানা মূল্যায়ন শুরু হলে সাব-কন্ট্রাক্টে চলা অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে।
দেখা গেছে, বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর মধ্যে ৯০০ থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন উল্লেখযোগ্য এমন কারখানার মধ্যে রয়েছে— পাইওনিয়ার সোয়েটার, এএমসিএস টেক্সটাইল, এমআর সোয়েটার কম্পোজিট লিমিটেড, সায়মা ডায়িং, গ্লোবাল ট্রাউজার্স লিমিটেড, সোহান সোয়েটার, টিফানিজ ওয়্যার লিমিটেড, লাইফ টেক্সটাইল, মৌসুমী নিটওয়্যার, এটিএন ফ্যাশন, নিটেক্স ড্রেসেস, অ্যারাউন্ড স্টারস সোয়েটার্স, হানারো ফ্যাশন লিমিটেড, ঢাকা ডায়িং, অটবি ফার্নিচার, সিপিএম কম্পোজিট ইত্যাদি।
এর মধ্যে নিটেক্স ড্রেসেসের চেয়ারম্যান শামিম হোসেন খান বলেন, গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যয় বহনসহ নানা সমস্যায় পড়ে তুলনামূলক দুর্বল বিনিয়োগকারী হিসেবে কারখানাটি চালু রাখা উচিত মনে করিনি। মণ্ডল গ্রুপ আমাদের ইউনিটটি কিনে নিয়েছে। বড় গ্রুপ হওয়ার পাশাপাশি তাদের আর্থিক সক্ষমতা ভালো বলেই আশা করছি নতুন কর্তৃপক্ষ কারখানাটি চালু রাখতে সফল হবে।
এ বিষয়ে শিল্প পুলিশের মহাপরিদর্শক আবদুস সালাম বলেন, আলোচ্য অঞ্চলগুলোর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দায়িত্ব শিল্প পুলিশের। এ কাজের সুবিধার্থেই আমরা কারখানাগুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতির হালনাগাদ রাখছি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আড়াই বছরে বন্ধ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫০০ কারখানা।
তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় শিল্প মূল্যায়নের দরুন পোশাক খাতের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এছাড়া অন্য শিল্প খাতের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে আর্থিক দুরবস্থা ও কাজের ঘাটতিতে। মূলত এ দুই কারণেই কারখানা বন্ধের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
শিল্প পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, বন্ধ হওয়া ৫৩০টি কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজারের কিছু বেশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘শিল্প পুলিশের হিসাবে এক লাখের বেশি হলেও আমাদের মতে, রানা প্লাজা-পরবর্তী প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন কারণে গত আড়াই বছরে চাকরি বা কর্মসংস্থানে সংকটের মুখোমুখি হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এরা প্রায় সবাই বস্ত্র ও পোশাক খাতের। এসব শ্রমিকের মধ্যে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকে কাজ নিয়েছেন একই বা অন্য শিল্প-কারখানায়। অনেকে পেশাও পরিবর্তন করেছেন।