ওয়াশিংটনের সাথে ফিলিপাইনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের অবসান! এমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেল দুতের্তে-জিনপিং বৈঠকে। বুধবার (১৯ অক্টোবর) বেইজিং গ্রেট হল অব দ্য পিপলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতের্তে জোরেসোরেই বলেছেন, ওয়াশিংটনকে গুডবাই বলার সময় হয়েছে। একই সাথে চীনকে স্বাগত জানাতে তিনি প্রস্তুত আছেন একথাও জানিয়ে দিয়েছেন। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সংঘাতের পথ পরিহার করে গভীর বন্ধুত্বের অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মার্কিন বিরোধী অবস্থান জানান দিচ্ছেন দুতের্তে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় আক্রমণাত্মক ভাষাও ব্যবহার করেছেন তিনি।
অবশ্য বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। যদিও বৈঠকের আগে উভয় দেশের গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকরা ধারণা করেছিলেন, এবার একটা এসপার ওসপার হবে। তবে উভয়পক্ষ এ নিয়ে আরো আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
বৈঠকে ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তির আওতায় মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাছ শিকারে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করবে এবং রেলওয়ে থেকে মহাসড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের পথ তৈরি করবে।
এই বৈঠক উভয়পক্ষকেই লাভবান করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে দুতের্তে বলতে গেলে পকেট ভর্তি করেই দেশে ফিরবেন। তাছাড়া বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানে অন্তত আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন দুতের্তে। এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং এখনো সরকারি বাহিনীর হাতে নিহতের ঘটনা ঘটছে।
আর এসময় চীন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মনযোগ আকর্ষণ করলো যা এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছে। তারাও প্রতিবেশীদের দেখিয়ে দিল যে বেইজিংয়ের সাথে সেও ভালোই খেলতে পারে!
ফিলিপাইনের পত্রিকাগুলোতে শি জিনপিংয়ের বক্তব্যের মধ্য থেকে একটি লাইন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে সেটি হলো: চীন-ফিলিপাইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই বৈঠকের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
আর দুতের্তের মতো কাঠখোট্টা মানুষও তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে কাব্য করেছেন। তিনি বৈঠক ও চুক্তিকে সিনো-ফিলিপাইন সম্পর্কের ‘বসন্ত কাল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে দুতের্তের এই রাষ্ট্রীয় সফর কাকতালীয়ভাবে মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটের দিনই ঘটলো। আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং চীনের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ফিলিপাইনকে আরো বেশি ওয়াশিংটনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি ম্যানিলা বেইজিংকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল এবং ফিলিপাইনের মাটি ও জলসীমায় মার্কিন সেনার উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিল।
কিন্তু চার মাসও হয়নি দুতের্তের ক্ষমতায় আরোহন। এর মধ্যেই তিনি ফিলিপাইনের ভোল পাল্টে দিয়েছেন। আদালত চীনের এই সমুদ্রসীমা বিরোধের নিন্দা জানালে দুতের্তে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করেন এবং বেইজিংয়ের সাথে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে বেইজিংয়ে চাইনিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেস এর চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ সু লিপিং বলেন, আমি মনে করি তিনি (দুতের্তে) একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন যার সর্বোচ্চ সুফল ভোগ করবে ফিলিপাইন।
তবে এই নতুন ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিদেনপক্ষে মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপনিবেশ এবং এই অঞ্চলে একটি অপরিহার্য মিত্র। কিন্তু জিনপিং-দুতের্তে বৈঠকের পর এই সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে পড়লো।
গত সেপ্টেম্বরে দুতের্তে একক সিদ্ধান্তে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মিন্দানাও দ্বীপ থেকে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ সমুদ্র মহড়া অব্যাহত না রাখারও হুমকি দেন এবং নিয়মিত বাৎসরিক সামরিক মহড়ার ঐহিত্যের বিলোপ ঘটানোর ঘোষণা দেন।
অবশ্য তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুতের্তে বাইরে এতো হম্বিতম্বি করলেও বাস্তবে তার সরকার এবং মিত্ররা কিন্তু এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। আর দুতের্তেরও কথার সাথে কাজে খুব একটা মিল নেই। যেমন: মিন্দানাও দ্বীপ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আহ্বানের পরপরই তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পরামর্শে অবস্থান থেকে সরে আসেন।
ফলে কূটনীতিকরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এই বাগাড়ম্বরের শেষ কোথায় আর নতুন নীতি কৌশল আসলে কোথা থেকে তিনি শুরু করতে চান।
তবে এমন উত্তেজনাকর মন্তব্য করে বেড়ানোকে পারস্পরিক দর কষাকষিরই একটি কৌশল বলেই মনে করছেন ম্যানিলা ভিত্তিক কূটনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীরা। তারা মনে করছেন, দুতের্তের কৌশল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে হাতে রেখে চীনের সাথে সুসম্পর্কের পথ উন্মুক্ত করা।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আকস্মিকভাবে সরে গেলে ফিলিপাইনকেও মূল্য দিতে হবে। কারণ ফিলিপাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং মিত্ররা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক। ফিলিপাইনের বৈদেশিক নীতি এবং সামরিক অবকাঠামো বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং মার্কিন অর্থের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
দুতের্তের সাবেক মন্ত্রণাদাতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল রামোসও সম্প্রতি চিঠি দিয়ে তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ল অব দ্য সি বিভাগের পরিচালক জে এল বাতোংবাকাল বলেন, দুতের্তের পরিকল্পনা নিয়ে বিহ্বলতা যুক্তরাষ্ট্রকে একপ্রকার সুচাগ্রে দাঁড় করিয়েছে। ওয়াশিংটন বুঝে উঠতে পারছে না আসলে তার বৈদেশিক নীতি কেমন এবং তার উপর ভরসা করা যায় কি না।
তাছাড়া এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত মার্কিনরা। ফলে দুতের্তেকে বুঝতে এবং তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী প্রশাসন দায়িত্ব পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল উইনভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের লি কাওয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির ডিন এডোয়ার্ডো আরারাল বলেন, সম্ভবত হিলারি ক্লিনটনই প্রেসিডেন্ট হবেন। ওবামা প্রশাসনের বৈদেশিক নীতি কৌশলে এশিয়ামুখিনতা ধরে রাখতে হলে পারস্পরকি শ্রদ্ধা এবং সংহতির ভিত্তিতে দুতের্তের সঙ্গে আলোচনা সামনে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তিনি কি সেটা করবেন?
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলে কী ঘটবে সেটা বলা মুশকিল। ট্রাম্প নিশ্চয় দুতের্তেকে পছন্দ করবেন! যোগ করেন আরারাল।
তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট