দারিদ্র্য একটি ভয়াবহ সামাজিক ও মানবেতর সমস্যা। এটি মরণব্যাধির মতো ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বে। সমাজে দুই ধরনের দারিদ্র্যের বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। একটি হলো প্রকৃত দারিদ্র্য (অ্যাবসোলিউট পোভারটি) যারা মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা কোনোটিই পায় না। আবার আরেক ধরনের দারিদ্র্য হলো আপেক্ষিক (রিলেটিভ পোভারটি), যারা কিছু কিছু মৌলিক চাহিদা মেটানোর প্রয়াস পায়। যাই হোক না কেন, দারিদ্র্যের কথা উঠলেই ক্ষুধার্ত কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেসব মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিনাতিপাত করছেন। আর আজকের বিশ্বে দখল পাল্টা দখল, যুদ্ধবিগ্রহ সবকিছুর মূলে কিন্তু এ খাদ্য চাহিদা। কারণ মানুষের সবগুলো মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম।
খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এ খাবারের জন্যই মানুষে মানুষে এত হানাহানি, রেষারেষি। যারা তিনবেলা তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে খাবার খেতে পায় না। সেই সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারে না তখন তাদের দরিদ্র বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাই এ খাবারের জন্য হানাহানি হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর সেটি আরো বেশি করে হয়েছে ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে। কারণ ধনী দেশগুলো দরিদ্রের সম্পদ শোষণ করেই প্রচুর পরিমাণ অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে থাকে। সে জন্য ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে খাবারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এক লক্ষাধিক মানুষ একত্রিত হয়ে সারা বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এক গণসমাবেশে যোগ দিয়েছিল।
সেদিন ছিল ১৭ অক্টোবর। সে জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক সেদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তখন থেকেই উক্ত দিনটিকে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতিবছর জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের অন্যতম সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রতিবছর বিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল কোনো দেশে তা ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে। গেল বছর (২০১৫) ঘানায় এ দিবসটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পালন করা হয়েছে। আর এটি আমাদের বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে, এবার (২০১৬) এ দিবসটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশে পালন করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ এরই মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিন্দুকদের কাছে একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ ছিল। এখন সেই নিন্দুকেরাই বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে সার্টিফিকেট দিচ্ছে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্য দেখে সন্তুষ্ট হয়ে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, এই তো সেদিন ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৩ শতাংশ। সেটি ২০০৯-১০ সালে কমে এসে দাঁড়িয়েছিল ১৮.৫ শতাংশে। আবার গত বছর অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯ শতাংশে, যা স্বয়ং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সংখ্যা আগামী দিনে অর্থাৎ জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে নির্ধারিত সময়সীমা ২০৩০ সালের আগেই বাংলাদেশ তা অর্জনের আশা রাখে।
বাংলাদেশ বিগত মাত্র দুই দশক সময়ে দুই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের এ অর্জন একটি মিরাকল হিসেবে সবার কাছে পরিগণিত এবং বর্তমানে সেটি বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলেও মনে করছে খোদ বিশ্বব্যাংক। অথচ এ বিশ্বব্যাংকই ২০১২ সালে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় সেখানে অর্থায়ন থেকে বিরত ছিল। আর বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল দেখার জন্য এবারের (২০১৬) বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম দুদিনের সফরে বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছেন। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে তার অতীত তিক্ততার সম্পর্ক ভুলে যেতে চাইছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে এর কর্তৃপক্ষ।
এ সফরকালে তিনি বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস পালন উপলক্ষে ১৭ অক্টোবর দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। এখান থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যান্য দরিদ্র দেশের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আত্মতুষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই বাংলাদেশসহ বিশ্বকে দারিদ্র্য বিমোচনে আরো অনেক দূরে এগোতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি বাস্তবায়নে যারা সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে, তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ঘোষিত এসডিজিতে যারা এগিয়ে যেতে পারবে তারা সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনে আরো এগিয়ে যেতে পারবে। এর বাইরেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের রয়েছে নিজস্ব রূপকল্প-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১, যাদের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত একটি দেশে পরিণত হবে। আর এখন থেকেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে দারিদ্র্য বিমোচনে অন্যতম রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকুক এটাই আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়